আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় -উর্বরা নাচ।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।
উর্বরা নাচ

অ-শিকারীগণ বন্য ফল-মূল সংগ্রহ করুক বা ভূমি কর্ষণ করুক না কেন অ-শিকারীদের প্রত্যাহিক জীবনের মূল উপাদান পর্যাপ্ত বৃষ্টি পাত সুতরাং আদিম সমাজে বৃষ্টি আবাহনের যাদু-টোনা ধর্মীয় প্রথার প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল, এমনকি উন্নত চীনা কৃষ্টিতে খৃষ্টের জন্মের এক হাজার বৎসর পূর্বে হর্ষোৎফুল্ল নাচে যাদুকারী কে অবশ্যই বৃষ্টি পাত ঘটাতে হত।
উত্তর পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় হর্ষোৎফুল্ল নাচের সবচেয়ে আদি ও অকৃত্রিম বৈশিষ্ট্যের ধারা পাই : বৃষ্টি আবাহনকারী পাথর অথবা বালুর স্তুপ তৈরী করে যাদুর পাথর চূড়ায় রেখে তার চারদিকে ঘিরে কয়েক ঘন্টা ধরে মন্ত্রতন্ত্র বলতে বলতে নাচে যতক্ষণ না সে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে তার সহকারীকে তা পরিচালনা করতে দায়িত্ব দেয়।
আরও সাম্প্রতিক কালের আবহাওয়া যাদু প্রশাখা প্রাচীন রোমের আরভাল পাদ্রীদের ভাবগম্ভীর শোভাযাত্রা, যেটা যাদুর সঙ্গে মাঠ প্রদক্ষিণ করে অতিক্রম করে এবং একই পোষাক-পরিচ্ছদ বর্তমানে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মধ্যে আছে। সবশেষে, বৃষ্টির যাদুমন্ত্র যত বেশী বিধিনিষেধ প্রাপ্ত হয় কল্পনাহীন নাচও তত জমির উর্বরতায় কাজে দেয় এমনকি আধ্যাত্মিক শক্তি বলে বহুদূর থেকেও। মেক্সিকোর কৃষিজীবি টারাহুমারাগণ একটা খালি বাড়ীর সামনে একজনকে সারাদিন ও রাতভর নাচতে এবং গান গেতে দেয় এজন্য যে, যারা মাঠে কাজ করে তারা সৌভাগ্য প্রাপ্ত হবে।
যখন আখের ডগা অথবা কামনাকৃত ফলের ঝোঁপা ঘিরে নাচা অথবা তাজা পাতা, চালের বস্তা বা রংবেরং এর ফিতা দিয়ে কেন্দ্রীয় দন্ড সুসজ্জিত করে নাচা হত তা এখন বর্তমানে আর কল্পনাপ্রবণ নাচ না। উত্তর ইউরোপীয়গণ শুধুমাত্র মে-পোল ঘিরে উজ্জল মধ্য-গ্রীস্ম রাতে নাচে না দক্ষিণ ইউরোপে বাস্ক তরবারি নাচনেওয়ালাগণ একই পদ্ধতিতে মে- পোল ঘিরে নাচে এবং একইভাবে হিন্দু, স্লিবিসের টোরাজা এশিয়ায়, কৃষিজীবি উত্তর ম্যাক্সিকোর মেয়েরা এবং ইউকাতানরা সহ আরো অনেকে।
এই পুরান আমেরিকান চক্র-নাচের বিশেষ উল্লেখযোগ্য উপাদান হচ্ছেন লম্বা রংবেরং এর ফিতা, যার এক মাথা দন্ডের সঙ্গে বাঁধা অপর মাথা নাচুয়ে ধরে থাকে গোলাকারে একটার উপর আর এটা ভাজ খেতে থাকে। এই একইভাবে এই লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে—–আলারসেকে— হ্যামেন্ট্যঞ্জ, দক্ষিণ ব্যাভারিয়ার ব্যান্ডেলট্যঞ্জর স্লাজ়বার্গ, ট্রিরোল, স্টেয়ারমার্ক এবং সিরেনবার্গ;
সিসিলির ব্যালো ডেলা করডেলা, প্রোভেন্সের মহিলা তাঁতী-নাচ; বাস্কুসদের তরবারি ঘুরান, স্পেনীয় ব্যালিস ডি সিনটাস এবং ডানজাস ডেল কর্ডন; ইউরোপের বাইরে হিন্দুস্তানের সাঁওতালদের নাচ এবং ভেনিজুয়েলার ইন্ডিয়ানগুলি এবং সবশেষে মধ্য- আমেরিকার ইন্ডিয়ান বালিকাদের নাচ, যা পূর্বে উল্লেখ আছে যেটা মোটেও ইউরোপীয়ানদের আমদানীকৃত না কেননা স্পেনীয় বিজয়ীগণ সেগুলি ওখানে আগে থেকে দেখেছে।
মাটিতে দন্ড পুঁতার বদলে আমরা পাই উত্তর-আফ্রিকা এবং সমগ্র ইউরোপে জীবন্ত গাছ যাকে পবিত্র উর্বরতার কেন্দ্র হিসাবে ঘিরে নাচা হত। উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা সাইলেশিয়ায় নারী পুরুষ খৃষ্টমাস রাতে ফলের গাছের নিচে দম্পতিরূপে দড়িতে পরস্পরকে বেঁধে নাচে। উর্বরা নাচ থেকে বিখ্যাত কারম্যানগোল অঙ্কুরিত—–যা ফরাসী বিপ্লবের চক্র-নাচ, স্বাধীনতা বৃক্ষ এবং গ্যালোটিন ঘিরে হয়। এই নামটি পিডমন্টের কারম্যানগোলা শহর থেকে নেয়া হয়েছে।
এটা নাচের দ্বিতীয় লক্ষ্যবস্তু, যখন সে নাচে সবুজ ধারণ করে তখন সে নিজেকে সমৃদ্ধির বাহন শক্তিরূপে অভিহিত হয়। ধারণাটা সর্বত্র একই যেমন : যখন দক্ষিণ আফ্রিকার এঙ্গোনীগণ বৃষ্টি-নাচে গাছের ডাল ভেঙ্গে তা হাতে ধরে রাখে, যখন পবিত্র বৃক্ষের চারপাশ ঘিরে আমোদ-প্রমোদের উৎসবে নাচে বাহুতে শস্য এবং ঘাস রাখে, যখন সুপ্রাচীন মিশরীয় নাচের মহিলা গণ আঙ্গুর লতা এবং দোলান ডাল দিয়ে নিজেদের সুসজ্জিত করে, যখন জাপানী মহিলা গণ আজুমা আসবিতে চেরীর ডাল দোলায়, অথবা যখন ইহুদী মহিলা গণ গড এর প্রতি পুরাতন শব্দ মনোযোগ দিয়ে শুনে ঃ
একেবারে প্রথম দিনে যাও এবং নাও
আবাক বৃক্ষ থেকে ফল, তালগাছের সুবাতাস,
ঘন কুঞ্জের পাতা,
পপলার সম ক্ষুদ্র নদী থেকে,
এবং তাঁর সম্মুখে আমোদ-প্রমোদ কর,
সর্বাগ্রে গড।
পাপুয়ার পৌরানিক কাহিনী এই ধারণাকে এক বিশেষ দিক্ নির্দেশনা দিয়েছে : ঘাস সূর্য উঠার রহস্য ভেদ করে যতক্ষণ না এর রেশ মুছে গিয়ে মেঘে ঢেকে যায়। দ্রাক্ষালতা দিয়ে ভূষিত নাচুয়ে শিম্পাঞ্জীর কথা আমাদের ভুললে চলবে না। সাজসজ্জার প্রয়োজন আদিকাল থেকেই বর্তমান ।
গাছ-নাচ সমন্ধে আমরা বলেছি সেটা প্রায়ই যৌন প্রয়োজনে বেশী, সেটা সম্ভবতঃ পূর্ব-এশিয়ার প্রাক্-চীনা কৃষ্টির বসন্ত- উৎসবে আরো সচ্ছ। অবিবাহিত তরুণ-তরুণী পরস্পরকে কোমরের নিচে আঁকড়ে ধরে দম্পতিসুলভ নাচতে থাকে শেষে তরুণটি তরুণীকে পিঠে উঠিয়ে নিয়ে যায়। আমাজন অঞ্চলের ইটোগাপুক এবং টিসালোর রিও ইয়াপুরার নাচ সাদৃশ্যপূর্ণ। নারী পুরুষ দম্পতিসুলভ নাচতে থাকে পরে দুইজন দুইজন করে রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায় ।
অন্য নাচ (পৃষ্ঠা-৩৮) এই নাচের মত একই ধরনের, যেটা আপাতঃদৃষ্টিতে কল্পনাহীন নাচ কতটুকু কোনভাবে বাস্তবধর্মী যৌন উন্মাদনায় অভিযুক্ত হতে পারে। দেহভঙ্গি ও প্রবৃত্তি অবশ্যই খুব যৌন ক্রিয়া প্রত্যাশা করে যেটা সে পূর্বাসক্ত। কিন্তু কল্পনাপ্রবণ নাচের মত এটার প্রাথমিক স্পৃহা সম্ভোগ না ।
কেউ কখনও যৌন উন্মাদনা পূর্ণ নাচকে সংরক্ষিত প্রথম দেহভঙ্গি এবং দ্বিতীয় দেহভঙ্গিতে ঐ ক্রিয়া প্রয়োগ করার মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না। যে মুহুর্তে যৌন-সম্ভোগ নাচর মধ্যে আসে এবং এটা শিল্পসম্মত ভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে পরে প্রায় সে পর্যন্ত এর সীমান্ত প্রসরিত থাকে ।

সাধারণভাবে অধিকাংশ ফসল উৎপাদন মানুষের কর্ষণে শুরু তা’ছাড়া অন্য আর কি হতে পারে? তথাপি নির্দিষ্ট নাচে আমরা খুব কমই বিশেষ বিষয় সমন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারি। এই নাচ কি জনগোষ্ঠী জন্মলাভের অথবা খাদ্যের প্রাচুর্যের জন্য ক্রমাগত অস্তিত্ব রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়? এই প্রশ্ন অবান্তর।
খাদ্যের উৎপাদন ও বংশবৃদ্ধি আদিম মানসিকতার চিহ্ন এবং এর কোন রূপক নাই । প্রতিটি আধ্যাত্মিক সচেতনতা প্রত্যেক পার্থক্যকে এর মধ্যে একীভূত করে নেয় এবং কোন তুলনামূলক আলোচক একে আলাদা আলাদা করার প্রস্তাব রাখলে আধুনিক পাশ্চাত্য চিস্তাধারা প্রবিষ্ট হয়ে বিজাতীয় জগৎ আমাদের জ্ঞানভান্ডারকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। আদিম মানুষ প্রকৃতি র সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে অঙ্গীভূত।
তাদের জীবন-লক্ষ্য পৃথিবী, সাগর, গাছ এবং জীবজন্তুর মধ্যে আবদ্ধ। বাইরের কাজ-কর্ম অথবা চিন্তাধারা তাদের মাঝে ঠাঁই পায় না। বীজ-বপন এবং যৌন- সম্ভোগ, অঙ্কুরায়ন এবং উৎপাদন, ফসল তোলা এবং বিতরণ সব কিছুই একই আইনে চলে।
যাইহোক, উর্বরতা ধর্মীয় পদ্ধতির হর্ষোৎফুল্লাসপ্রবণ কল্পনাহীন নাচকে কোনভাবে বাইরের পরিচালিত কার্যপ্রণালীর বিষয়বস্তু হিসাবে গণ্য করে না। তারচেয়ে একটা আধ্যাত্মিক শক্তি কোন লিঙ্গের অবস্থান সংশ্লিষ্ট হয়ে পরলে এবং অন্যটিকে পরিবেষ্টিত করলে তারা সংগ্রাম করে।
এই রকম প্রাচীন উদাহরণ কগোলের মিওলিথিক রক পেইন্টিং, পূর্ব স্পেনের লেরিডা প্রদেশে যার অবস্থান (প্লেট-১)।
এখানে দেখা যাচ্ছে নয়জন (!) পোষাক পরিহিত মহিলা একজন নগ্ন বালককে ঘিরে নাচ করছে যার বড় লিঙ্গের মাথায়পাতলা পর্দাযুক্ত। এই নয়জন মহিলার নাচ থেকে আমরা হাজার বছরের বৃত্তকার উৎসব-নাচের দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারি যেখানে নয়জন গোপী (গোয়াল কন্যা) কৃষ্ণকে এবং নয়জন গ্রীক কবিতার দেবী এ্যাপোলো কে ঘিরে নাচ করে ।
আব্বে ব্রীউল এবং জে, ডাব্লু, হায়র, কগোল চিত্রের মধ্যের লোককে দেবতা রলে মনে করেন যেটা সঠিক না। যে ঘটনাকে প্রতিনিধিত্ব করা হচ্ছে তার সমকক্ষ এমনকি সাম্প্রতিক কালেও কোন ছবিকে আর সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করানোর প্রয়োজন নাই। চ্যাকো ইন্ডিয়ান ও বুশম্যান কগোল পর্বতে গ্রিমালডী নির্ঘোয়ডের সঙ্গে হয়তবা অকৃত্রিম ভাবেই সমন্ধ যুক্ত এমনকি আজও তারা একত্রে মেয়েরা পুরুষকে ঘিরে নাচে ।
ওয়নয়ামওইজীদের বিবাহে বর মহিলা পরিবেষ্টিত হয়ে মাঝখানে নাচে এবং মধ্য অস্ট্রেলিয়ার চারজন পুরুষ আটজন মহিলা পরিবেষ্টিত হয়। পক্ষান্তরে ফিলিপাইন নিগ্রিটসদের মধ্যে একটা মেয়ে দাঁড়ায় তাকে ঘিরে পুরুষগণ নাচে, পূর্ব আফ্রিকার ডিনকা এবং মোরুদের মধ্যে একদল নারী চক্রের মধ্যে থাকে ।
বুশম্যান এবং ফিলিপাইনী নিগ্রীটস পাশাপাশি পরিস্কার দেখা যায়। এই প্রধান প্রসঙ্গ একটা মৌলিক কৃষ্টির অংশ বিশেষ, সুতরাং এটার সঙ্গে দেব-দেবীর প্রতিকৃতির কোন যোগাযোগ নাই। এই একই মূল উপাদান ইউরোপে সংরক্ষিত বিশেষ করে অস্ট্রিয়ান ও সুইডেনের লোক-নাচে দৃশ্যমান। যেমন শিশুদের নাচের মধ্যে বৃত্তের মাঝখানে রাজকুমার বা রাজকুমারী এপ্রন মাথা পর্যন্ততুলে থাকে ।
পলেনেশিয়ান প্রথা আমাদেরকে আরো আগায়ে নিয়ে যায়। হাওয়াইতে নাচুয়ে পুরুষদের চক্রের মধ্যে মহিলা গণ বসে থাক সে হাতের লাঠি দিয়ে প্রত্যেক মহিলার বিপরীতে আঘাত করে যতক্ষণ না সে কাউকে সঠিকভাবে পছন্দ করে, সে তাকে ভারী ফিতা বা হালকা ফিতা দিয়ে স্পর্শ করে।
হাওয়াইয়ান এই সঙ্গী পছন্দের নাচের মূল উপাদান ইউরোপের লোক-নাচে পুনরাবৃত্তি ঘটায় যেমন পরিস্কারভাবে ইংরেজদের বেবিটি বোষ্টার এবং বহেমিয়ান সাটেক্ মেয়েরা হাত ধরে বৃত্তাকারে ছেলেটাকে মাঝে রাখে সে যাকে পছন্দ করে তার হাতে এক টুকরা কাপড় দিয়ে দেয়। এই নাচ জার্মানীর শিশুদের বৃত্ত-নাচ যেখানে বাজকুমার তার সঙ্গীনী পছন্দ করে এই বলে “যেটা বাজে সেই শিকল ভাগ“ যেখানে অনুকরণাত্মকের সীমানা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।

উর্বরা নাচের একটা বিভাগের শেষ অংশে আমরা অবশ্যই বিশেষ উল্লেখযোগ্য অংশ উদ্ধৃত না করে পারি না যে, অনেক ইন্দো-চীন রোপণকারী (কৃষিজীবী) জনগোষ্ঠীর মধ্যে বীজ-বপন এবং ফসল কাটার মধ্যবর্তী সময়ে নাচ করার (প্রথা) অনুমতি নাই।
এটা এবং সকল বৃহদাংশের আদিমানবগোষ্ঠীর মধ্য একটা গূঢ় সম্পর্ক বিদ্যমান আছে যে, রীতিগত, নীতিগত বা ধর্মগত বিধি-নিষেধের কারণে ফসল কাটার পূর্বে কোন নাচ করা যায় না। আমাদের নিজেদের “নাচের ঋতু” শরৎকাল থেকে শীতকালের শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত যেটার পিছনে এক বিরাট ইতিহাস আছে ।
আরও দেখুনঃ
