আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – চক্কর নাচ।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।
চক্কর নাচ

১৯৩০ এবং ১৯৩২ সালে লেখক প্রায় প্রতি শুক্রবার বিকেলে দরবেশের নাচ প্রত্যক্ষ করেন। ব্যাপটিষ্ট চার্চের মত অষ্টভূজ অঙ্গন বিশিষ্ট নিভৃত একটি বিশেষ বাড়ি ছিল। নিচ তালা কাঠের গোল রেলিং ঘেরা নাচের আঙ্গিনা ছিল। উপর তলায় গোল ব্যলকনি একদিকে পুরুষদের অন্য দিকে সতর্কভাবে পর্দা ঘেরা মহিলাদের জন্য এবং যন্ত্রশিল্পীদের জন্য একটা প্লাটফর্ম ছিল।
সতের জন বয়স্ক ফকির গোল হয়ে বসে আছে মাথায় লম্বা ফেল্ট সজ্জিত। প্লাটফর্মের উপর থেকে একজন খুবই বৃদ্ধ দরবেশ অনুনাসিক শব্দে পবিত্র কোরান থেকে বার বার দোয়া পাঠ করছিল। সিকি ঘন্টা পরে একজন বাঁশীবাদক তার স্থান নেয়। ভাল, ক্রমাগত উচ্চস্বরে কখন কখন অন্যজন গম্ভীর স্বর বাজাতে থাকে। আবার সিকি ঘন্টা পরে আগের দরবেশ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি সহকারে সে স্থান নেয়।
এবার যন্ত্রসঙ্গীত আরো অধিক উত্তেজক হতে থাকে যখন তিনটা বাঁশী একটা বেহালা স্বরের সঙ্গে ঐক্যতান হয় যেটা পুরান তুর্কী চিহ্ন উদ্ঘাটিত করে। একটা ট্রাম্বুরিন, কয়েকটা ছোট ড্রাম (ভেরী, দামামা) যেন দৈব আওয়াজ আরম্ভ হয়। তেরজন ফকির আস্তে আস্তে ঘড়ির কাটার বিপরীতে ঘুরতে থাকে। তারা শান্তভাবে হাঁটে। একটা নির্দিষ্ট চিহ্নে পৌঁছে নাচুয়ে তার পিছনের জনের দিকে ঘুরে পরস্পরকে নিচু হয়ে বাউ করে।
বাজনার পরিবর্তন হয়, মাক্কাম এবং ছন্দ বদল হয় তখন তারা তাদের আলখাল্লা খুলে ফেলে দেয়। দশজন সাদা মস্তকাবরণ নিয়ে দাঁড়ায় তাদের সঙ্গে একজন কালো, একজন মুয়ুরপঙ্খী রং ও একজন বাদামী রং এর। শেষের দিকে আখড়ার প্রধান ঠিক লেখকের নিচে ছিল।
অন্যেরা তার কাছে হেঁটে গিয়ে বাউ করে চুমু খেল। তখন দশজন উর্ধমুখি ফেনিল হয়ে উঠে দুইবাহু উড়োজাহাজের মত ছাড়ায়ে এমন ভাবে পাক খেতে শুরু করে যে, একজনের মাথার ঢাকনা অন্যের উপর পরে, তাদের চারদিকে রাখা বড় ঘন্টা তারা গঠন করে।
চার দরবেশ ছোট গোলক এবং ছয়জন বড় গোলক তৈরী করে তারা ক্রমাগত চক্কর খেতে থাকে তাদের মধ্যে প্রধান, কালো মাথা আবরণ যার, আস্তে ঘুরে দুই গোলকের মাঝখানে আবার উল্টা ঘোরা দেয়। দু’বাহু ছাড়ায়ে এই বৃদ্ধসকল পুরা আধা ঘন্টা লাটিমের মত চক্কর খেল সত্যই সেটা বিস্ময়কর স্মরণীয় অনুষ্ঠান। এখানে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গভঙ্গি ও গতিপ্রকৃতি নাচের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
নেশা ঘোরে নাচুয়ে শরীর ও আত্মার সচেতনতা অনুভব করতে পারে না। শরীরে ভার ছেড়েই নেশাঘোর জয় করতে পারে। আমার সঙ্গে যে সমস্ত ডাক্তার ছিল তারা দরবেশদের যোগধ্যানী অবস্থায় পরীক্ষা করে। এই নাচের তাৎপর্য সম্পূর্ণভাবে নাক্ষত্রিক বা আধ্যাত্মিক ।

চাঁদ-সূর্য ও ঘূর্ণিয়মান তারকামন্ডলী। এতে সন্দেহ নাই যে এটা আদিম । ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের কয়েক হাজার বৎসর পূর্বে ধারণকৃত ঐতিহ্যসূত্রে মধ্য এশিয়ার ফকিরতত্ত্ব (বাউল) বা শ্যামানিজম থেকে এর উৎপত্তি। সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় সর্বাঙ্গীন সুন্দর এবং খুবই হৃদয়গ্রাহী। পারস্যের প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক করি জালালউদ্দিন রুমীর কয়েকটি চরণ মনে পড়ে যায় :
শব্দে যে ঢোল বাজে বাঁশীর প্রতিধ্বনিতে !
আল্লাহু !
নাচে ঐ তরঙ্গায়িত উষায় !
আল্লাহু !
ঐ সূর্য সর্ব শক্তিমান যিনি নিয়ন্তা সৃষ্টি করেছেন জলন্ত আত্মায় ঘুরপাক খায় গ্রহ উপগ্রহ প্রতিক্ষণ!
আল্লাহু !
ওহ হৃদয়! ওহ বিশ্ব! প্রভুকে ভালবেসে!
অন্য নাচন আর সব শূন্যে
আল্লাহু!
প্রেমের বন্ধন যাবে বাইরে
সুদূর সুর্য-ঊষা ছেড়ে ছেড়ে….. ইউরোপে “আত্ম-সম্মোহনী” মূলক সঙ্গীত প্রসঙ্গে আর্মেনিয়ার রাশিয়ান ফেরকার মলোকানিদের চক্কর নাচ পরিস্কারভাবে বর্ণনা করা আছে। স্কপটিজদের আত্ম-পৌরুষত্ব এবং খ্রিষ্টিগণ একটা পানির গ্লাসের চারদিকে চক্কর দেয় ও নিজেদের চাবুকমারে যতক্ষণ না তারা যীশু হয়ে উঠে দৈববাণী উচ্চারণ করতে পারে।
পঞ্চদশ শতাব্দীর আগষ্টিনো-ডি-ডুসিও দৈব উন্মাদনায় এঙ্গেলের মত বাঁকা হয়ে যায় তার এই মোহাবিষ্ট অবস্থা পশ্চিম ইউরোপেও বুঝা ও অনুভব করা যেত। প্রাচীনকালে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী সকল দেশ ও এশিয়ার অগ্রবর্তী এলাকায় চক্কর নাচ বিদ্যমান ছিল।
সদ্য খননকৃত গীজার কাছে প্রাচীন মিশরীয় সম্রাটদের প্রাচীর চিত্রেও দেখা যায় নিগ্রো রমনী আঙ্গুর গাছের অলংকার পরিহিত খৃঃপূঃ ১৩০০ শতকে থিবসের ১১৩নং সমাধি ক্ষেত্রে প্রাপ্ত মৃতদেহ সংরক্ষণ কক্ষে, যার তাৎপর্য অন্য কিছু করা যায় না।
খৃঃপূঃ সপ্তম শতাব্দীতে আসীরীয় সৈনিকগণ লাটিমের মত ঘুরতে পারত এবং তুর্কীস্থানের নর্তকীগণ চক্কর নাচকে সুদূর চীন পর্যন্ত নিয়ে যায়। এই রকম পুরান ইহুদীদের মহিলা-নাচ সম্ভবতঃ প্রায়ই চক্কর নাচ। আজও ব্যবহৃত (অক্ষর – ৪) ম্যাহোলশব্দ মেয়েদের নাচের প্রতিশব্দ যেটা এসেছে (অক্ষর-৫) হাল ক্রিয়া থেকে অর্থ ঘুরা এই শব্দ গোলকে তরবারি ঘুরান এবং ঘূর্ণিপাক বায়ু উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়।
সত্যিকার অর্থে এই ঘুরপাক দরবেশদের চক্কর না।ফিরে এস ফিরে এস হে সোলায়মান; ফিরে এস ফিরে এস যেন আমরা তোমাকে দেখি ।কেন আমরা সোলায়মানের দিকে তাকাব, যেমন মহানাইমের নাচ আমরা দেখব ?
যখন আমরা গান থেকে গানের এই কলি আবৃত্তি করে বুঝতে পারি এটা চারদিকে ঘিরে ঘিরে গাওয়ার উপযুক্ত। এটা খুব সম্ভবতঃ তরবারি নাচ অথবা কোন গোলক নাচে এই লাইনগুলি গাওয়া খুবই যুক্তিযুক্ত। ভৌগলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে চক্কর নাচের শ্রেণীবিন্যাস করা সবচেয়ে উপযুক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীগণ এই নাচ করে থাকে।
এটা অভ্রান্ত ভাবে বলা যায় ঘনিষ্ঠ নাচের ভঙ্গিমার বৈশিষ্ট্যেপূর্ণ : লোয়াঙ্গোতে হালকা গন্ডোগোল, তলপেট পাকানো, সামনে পিছনে লাফ দেয়া; ছৌ হিন্দুস্থানের নরমভাবে দোলান এবং সংহত বাহুদ্বয় থাকে, স্লিবিসে আস্তে আস্তে হাঁটে; পিউবলোগণ গোড়ালী জোড়া করে চাপ দেয়, স্লাইড করে ও ঘুরপাক খায়।
এমনকি যেখানে পুরুষগণ নাচে অংশ নেয় সেখানেও ছড়ান নাচ করার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে পা সলজ্জভাবে চলে; বাস্কিরগণ এক বাহু লঘুভাবে প্রসারিত করে অন্য বাহু কোমরে রাখে; দরবেশ ক্রমাগত গর্জন করে, এমনকি পামির-তাজিকদের তরবারি নাচ অসংংখ্য তীক্ষ্ণ অস্ত্র-সস্ত্র পশুর চামড়ায় আবৃত রেখে সুদৃশ্য ঘূর্ণীয়মান প্যার্টানে আবদ্ধ থাকে। এ জন্যেই চক্কর নাচকে ঘনিষ্ঠ-নাচে শ্রেণী বিন্যাস করা প্রয়োজন ।

সবশেষে সর্বোতভাবে বলতে হয় এই পদ্ধতির শ্রেণী বিন্যাসে চক্কর নাচ নারীশক্তির সৃষ্টিধর্মী শিহরণমূলক অভিব্যাক্তির স্বীকৃতি। ঘুরপাক খাওয়া দরবেশ দুই বাহু দিগন্ত মুখে প্রসারিত করে তালু উপরের দিকে রাখে মনে হয় কিছুই চাওয়ার নাই সেই দেহভঙ্গিমা কি এক স্বর্ণদ্বার উদ্বোধন করে।
কোন কিছু তার থেকে জন্মাবার ক্ষমতা রাখে না, নিজেই বাহ্যিক শক্তি তার উপর ভর করার জন্য অপেক্ষ করে যেটা তার শরীরের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে তার চেতনা নির্বাপিত করে এক অলৌকিক শক্তি তার মধ্যে বিরাজ করতে থাকে। চক্কর নাচ নাচের মধ্যে সবচেয়ে খাঁটি আকারে নাচের একাগ্রতা বহন করে।
আরও দেখুনঃ
