নৃত্যসাধক ঈশ্বরী প্রসাদ: কথক নৃত্যের পুনর্জাগরণের প্রবর্তক

ভারতের প্রাচীন নৃত্যসংস্কৃতির ধারায় ঈশ্বরী প্রসাদ এক ঐতিহাসিক ও কিংবদন্তিময় নাম। তিনি ছিলেন এলাহাবাদের (বর্তমান প্রয়াগরাজ) নিকটবর্তী ইন্ডিয়া নামক গ্রাম-এর এক গভীরভাবে ধর্মনিষ্ঠ ও সঙ্গীতপ্রেমী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। পরবর্তী সময়ে তিনিই “নটবরী নৃত্য” বা আধুনিক কথক নৃত্যের নবজাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। কথিত আছে, তিনি ছিলেন লখনৌ ঘরানার প্রথম নৃত্যনায়ক এবং বাংলায় বিখ্যাত নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের নৃত্যগুরু ঠাকুরপ্রসাদ-এর প্রপিতামহ। তাঁর অবদান শুধু একটি নৃত্যশৈলী সংরক্ষণেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তিনি ভারতীয় নৃত্যকলাকে এক নবরূপে পুনর্জীবন দান করেছিলেন।

নৃত্যসাধক ঈশ্বরী প্রসাদ: কথক নৃত্যের পুনর্জাগরণের প্রবর্তক

দৈব অনুপ্রেরণা ও নৃত্যসাধনার সূচনা

ঈশ্বরী প্রসাদের জীবন নিয়ে একটি কিংবদন্তি বিশেষভাবে প্রচলিত। বলা হয়, একদিন তিনি স্বপ্নে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-এর কাছ থেকে এক দিব্য আদেশ পান। সেই আদেশ ছিল—প্রাচীন “নটবরী” বা “কথক” নৃত্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, যাতে ভগবানের লীলানৃত্যের ঐশ্বরিক রূপ আবার মানুষের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। এই স্বপ্নদর্শনই তাঁর জীবনের বাঁক ঘুরিয়ে দেয়। এরপর থেকে তিনি সারাজীবন সেই নির্দেশ অনুসারে নৃত্যকলা চর্চা, সংরক্ষণ ও শিক্ষার ব্রত গ্রহণ করেন।

ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ঈশ্বরী প্রসাদ তাঁর জীবনের শেষ অবধি কথক নৃত্যের সাধনায় নিবেদিত ছিলেন। তিনি প্রায় আশি বছর ধরে এই নৃত্যের পুনর্জাগরণ ও বিকাশে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর নৃত্যসাধনা কেবল শরীরী অনুশীলন ছিল না—তা ছিল একধরনের ধ্যানমগ্ন ভক্তি, যেখানে শ্রীকৃষ্ণের লীলাকে নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো।

পরিবার ও উত্তরাধিকার

ঈশ্বরী প্রসাদের তিন পুত্র ছিলেন—অভুগে, খড়গ, এবং তুলারাম (তুলকে)। তিনি তাঁদের প্রত্যেককে নিজ হাতে কথক নৃত্যের গভীর শিক্ষা প্রদান করেন। এই তিন পুত্রের মাধ্যমেই তাঁর নৃত্যসাধনার ঐতিহ্য উত্তরাধিকার সূত্রে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে যায়। কথিত আছে, ঈশ্বরী প্রসাদ তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিদিন নৃত্যচর্চা চালিয়ে গেছেন এবং তাঁর শেষ বয়সেও তিনি নৃত্যকে ভগবানের সেবারূপে পালন করতেন।

দুঃখজনকভাবে, শতবর্ষ ছুঁই ছুঁই বয়সে তাঁর জীবনের অবসান ঘটে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনায়। বলা হয়, তিনি একদিন মাছ ধরার জন্য কেঁচো খোঁজার সময় সাপের দংশনে মারা যান। তাঁর পত্নী, যিনি তখন পঁচানব্বই বছর বয়সে উপনীত, স্বামীর মৃত্যুসংবাদ শুনে গভীর শোকে সহমরণ বরণ করেন। এই ঘটনাটি আজও ভারতীয় নৃত্যজগতে এক গভীর বেদনা ও অনুপ্রেরণার প্রতীক হিসেবে স্মরণ করা হয়।

ঈশ্বরী প্রসাদের উত্তরসূরি ও লখনৌ ঘরানার সূচনা

ঈশ্বরী প্রসাদের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রদের মধ্যে খড়গ শোকে ভেঙে পড়ে নৃত্যচর্চা ত্যাগ করেন। অন্যদিকে, তুলারাম সংসার থেকে বিমুখ হয়ে একপ্রকার সন্ন্যাসীজীবন বেছে নেন। একমাত্র আড়গাজী নামক একজন ঘনিষ্ঠ শিষ্য তখন তাঁদের পরিবারের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধ থেকে ঈশ্বরী প্রসাদের নৃত্যঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেন। তিনি ঈশ্বরী প্রসাদের নাতি—প্রগাস, দয়াল ও হরিলাল—এই তিনজনকে নৃত্যশিক্ষা দিতে শুরু করেন এবং তাঁদের মাধ্যমেই কথক নৃত্যের ধারা পুনরায় বিস্তৃত হয়।

ঈশ্বরী প্রসাদের নাতি প্রগাসজি-ই পরবর্তীতে তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। প্রগাসজি তাঁর দুই ভাই দয়াল ও হরিলালকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান লখনৌ, যেখানে তাঁরা নবাব আসিফ উদ্দৌলার (১৭৭৫–১৭৯৫ খ্রি.) দরবারে নৃত্যশিল্পী হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখান থেকেই কথক নৃত্যের লখনৌ ঘরানার ভিত্তি স্থাপিত হয়, যা পরবর্তীতে নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন রূপ, শৈলী ও সৌন্দর্যে বিকশিত হয়।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার

ঈশ্বরী প্রসাদের জীবনী কেবল এক ব্যক্তির নৃত্যচর্চার কাহিনি নয়—এটি ভারতের আধ্যাত্মিক শিল্পসংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। তাঁর মাধ্যমেই কথক নৃত্য শুধু ধর্মীয় উপাসনা থেকে বেরিয়ে এসে এক সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক শিল্পরূপে বিকাশ লাভ করে। তাঁর পরিবার ও শিষ্যরা এই ধারা অব্যাহত রাখেন, যা পরবর্তীতে ভারতের অন্যতম প্রধান শাস্ত্রীয় নৃত্যরূপ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

আজকের দিনে কথক নৃত্যশিল্পীরা ঈশ্বরী প্রসাদকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন “নৃত্যযোগী”, “প্রথম কথক গুরু” এবং “নটবরীর পুনরুজ্জীবক” হিসেবে। তাঁর জীবনের মূল বার্তা ছিল—নৃত্য শুধু শরীরের অনুশীলন নয়, বরং আত্মার জাগরণ।

ঈশ্বরী প্রসাদের জীবনকাহিনি যেমন ইতিহাসের আড়ালে আবৃত, তেমনি কিংবদন্তির মায়ায় ঘেরা। তবু তাঁর কর্ম ও সাধনার ফলেই ভারতীয় নৃত্যের অন্যতম প্রাচীন ধারা আজও জীবন্ত ও বিকশিত। তাঁর জীবনের এই গাথা প্রমাণ করে—যে শিল্পী নিজের সাধনাকে ভগবানের উপাসনা হিসেবে গ্রহণ করেন, তাঁর সৃষ্টি কখনও বিনষ্ট হয় না। ঈশ্বরী প্রসাদ তাই কেবল একজন নৃত্যশিল্পী নন, তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির এক অমর নৃত্যঋষি

Leave a Comment