আজকে আমরা আলোচনা করবো রঙ্গমঞ্চ ও তার প্রয়োজনীয়তা

রঙ্গমঞ্চ ও তার প্রয়োজনীয়তা
গীত, বাদ্য, নৃত্য, নাট্য যে কোন কলাই হোক না কেন, তার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শনের ব্যবস্থাও করে গেছেন প্রবর্তকেরা।
কলাকার যেমন তাঁর কৃতি সকলকে পরিবেশন করে আনন্দ পেতে চান, কলারসিক দর্শক ও শ্রোতৃসাধারণও তেমন চান প্রত্যক্ষভাবে সেই কলার রস আস্বাদন করতে। যে স্থানে বসে শ্রোতা বা দর্শকেরা এই রস উপলদ্ধি করে। পরিতৃপ্ত হন, সেই স্থানটিকেই বলা হয় প্রেক্ষাগার, প্রেক্ষাগ্রহ বা রঙ্গালয় ইত্যাদি। এবং রঙ্গালয়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত যে নির্দিষ্ট মঞ্চটির ওপর কলা প্রদর্শিত হয়, সেটিকে বলা হয় রঙ্গমঞ্চ ।
আজ বাংলাদেশের নাট্যমোদী জনসাধারণ সরকারের কাছে প্রায়ই দাবী জানান একটি জাতীয় রঙ্গমঞ্চের জন্য। সকলেরই জানা আছে, নাট্যাচার্য’ শিশিরকুমার ভাদড়াও এই কোড ও বেদনা নিয়েই স্বর্গত হয়েছেন। জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রঙ্গমঞ্চের অবদান এবং প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
ভারতীয় রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস অতি প্রাচীন । সমগ্র ভারতের সেই প্রাচীন ঐতিহ্য আজও প. বাংলা প্রশংসনীয়ভাবে বহন করে আসচে নানা বিপর্যয় ও দাবি’ পাক সত্ত্বেও। গভীর পরিতাপের বিষয়, সেই প. বাংলা পারল না আজও পর্যন্ত একটি জাতীয় রঙ্গশালা নির্মাণ করতে। অবশ্য কলকাতার ‘রবীন্দ্র সদন’ রঙ্গালয়টির উদ্বোধনকালে ( ১৯৬৬, ৯ই মে ) শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর শভেচ্ছাবাণীর যে ‘টেপ’ শোনানো হয়েছিল, তাতে এই প্রেক্ষাগারটিকে ‘জাতীয় মঞ্চ’ বলে ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সেটিও কলকাতার অন্যতম ভাড়াটে রঙ্গমঞ্চের উর্ধ্বে উঠতে পারি নি ।

আজকাল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নানা রকমারি নয়নাভিরাম প্রেক্ষাগৃহ বা রঙ্গালয় নির্মিতি হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় উন্নত ধরণের রঙ্গমঞ্চের অভাব উপলব্ধ হচ্চে বিশেষ ভাবেই। সকলেরই এই অনভূতি আছে যে সঙ্গীত (নৃত্যগীতাদি ) বা নাট্য প্রদর্শনের ক্ষেত্র তথা পরিবেশে যদি প্রদর্শিত কলার অন,কুল না হয়—তাহলে একদিকে যেমন কলাকু গলাঁদের পক্ষে নানা অসুবিধা হয়, তেমনি প্রেক্ষকদেরও ( দর্শক ও শ্রোতা) আরামে বসে তা উপভোগ করতে এবং পরিপূর্ণ রসোপলব্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে। সেই জন্যই রঙ্গালয় ও রঙ্গমঞ্চ নির্মাণ শিল্পকে সর্বদেশে সর্বকালেই বিশেষ গুরত্ব দেওয়া হয়েছে ।
ভারতীয় সঙ্গীত প্রধানত ধর্মীয় ও দরবারী সংগীতরূপে পরিচিত হওয়ার জন্য দেশী-বিদেশী অনেক পণ্ডিতেরাই মনে করেন, প্রাচীন ভারতে বুঝি কোন স্থায়ী রঙ্গালয় বা রঙ্গমঞ্চ ছিল না। মন্দির সংলগ্ন নাটমন্দির এবং রাজপ্রাসাদের সভাগৃহে বা সংগীতগালাই ছিল নাট্যাননুষ্ঠানের প্রদর্শন স্থল। কিন্তু এরূপ ধারণা যে ভিত্তিহীন, তার প্রমাণ মেলে ভরতের নাট্যশাস্ত্র অধ্যয়ন করলে।
নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত প্রাচীন কালের রঙ্গালয় ও রঙ্গমণ্ডের পরিকল্পনা তথা স্থাপত্য কলার কিছ, সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে করা যেতে পারে। এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যেমন কিছ, ভ্রান্ত ধারণা সবন্ধে অবস্থিত হব, তেমনি রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজনীয়তার ওপর কতখানি গৰুত্ব প্রাচীন কালে দেওয়া হত তারও কিছুটা পরিচয় পাব ।
নাট্যশাস্ত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে যে, ব্রহ্মার আদেশে দেবহুপতি বিশ্বকর্মা নির্মাণ করেছিলেন ‘নাট্যবেদ’ বা ‘নাট্যমণ্ডপ’। আয়তনের তারতম্য অনুসারে মোট তিন রকম নাট্যমগুপের বর্ণনা সেখানে আছে, আর প্রত্যেকটিরই আবার জ্যেষ্ঠ, মধ্য ও অবর রূপে করা হয়েছে তিনটি করে উপবিভাগ। যেমন ঃ (১) বিকৃষ্ট=বিজ্যেষ্ঠ, বিকষ্টমধ্য ও বিষ্টাবর। (২) চতুরস্র চতুরস্রজ্যেষ্ঠ, চতুরপ্রমধ্য ও চতুরস্রাবর। জ্যেষ্ঠ, তাম্রমধ্য ও প্রাস্রাবর।

ভরত বলেচেন, বিকষ্ট শ্রেণীর জোষ্ঠ প্রেক্ষাগৃহ নির্দিষ্টি ছিল দেবতাদের জন্য। অভিনবগুপ্তের অনুমান, সম্ভবত দেব- দানবের সাধাদি প্রদর্শনের জন্য এই প্রেক্ষাগারের আয়তন দীর্ঘ হত। মধ্য প্রেক্ষাগৃহ ছিল মনুষ্যোপযোগী। এই মধ্যম শ্রেণীর ( ৬৪x৩২ বর্গ’হাত ) প্রেক্ষাগৃ, হকেই ভরত বলেচেন উত্তম এবং নিষেধ করা হয়েছে এর চাইতে বড় মঞ্চ নির্মাণ করতে :- (C) PRICE-
অত ঊর্ধ্বাং ন কৰ্ত্তব্য : কর্তৃভিনাট্যমণ্ডপঃ
যাদব্যভাবং হি তর নাট্যং ব্রজেদিতি । (১৮)
প্রেক্ষাগৃহাণাং সর্বে বষাং তস্মান্মধ্যম মিষ্যতে ।
যস্মাৎ পাঠ্যং চ গেয়ং চ সুখং প্রবাতরং ভবেৎ ।। (২১) ৷৷ অ. ২ ॥
রঙ্গালয় বা নাট্যগ্রহের ভিত্তি স্থাপনার পূর্বে ঐ ভ‚মির উৎকর্ষ- অপকশে’র পরীক্ষা করে নেওয়া হত ভাল ভাবে। ঐ ভূমি নমতল, কঠিন, কালো এবং উজ্জ্বল হওয়া দরকার। শুভ্রবর্ণের স্বাস্থ্যবান কৃষ দ্বারা কর্ষণ করে, লোহা, হাড় প্রভৃতি অপবিত্র তথা অপরিষ্কৃত বস্তুগুলি নিষ্কাষণ করে, ভূমি বা মাটিকে শত্রুদ্ধ এবং রঙ্গালয়ের উপযোগী করে নেওয়া হত । তারপর অনুরোধা, তিষ্য ও পয্যা প্রভৃতি প্রশস্ত নক্ষত্রে, শত্রুবর্ণের সূত্র দ্বারা ঐ জমি পরিমাপ করা হ’ত। পরিমাপের সূত্র বা রাশিটি যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া দরকার, যাতে পরিমাপের সময় কোন রকমেই সেটি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন না হয়। তাহলে রাষ্ট্রকোপ, সূত্রধার প্রভৃতির মৃত্যু বা নানা অমঙ্গল সূচক ঘটনার আশংকা থাকে।
তারপর আরেকটি শুভ তিথি-নক্ষত্রযোগে অনরূপে সূত্রে দ্বারা শঙ্খে চিত্তে প্রথমে সমান দা ভাগে ( প্রতি ভাগ ৩২x৩২ বর্গ হাত ) ভূমিকে বিভক্ত করা হত। অর্ধেক দর্শকের জন্য, বাকি অর্ধেককে আবার ভিন্ন তিন ভাগে (যথাক্রমে ৩২৮ ৩২৮ ও ৬২x১৬ বর্গহাত ) বিভন্ন করা হত ‘রঙ্গপীঠ’ ‘রঙ্গশীর্ষ’ ও ‘নেপথ্যগ্রহ’ নির্মাণের জন্য।
এরপর ভিত্তি স্থাপনোৎসব। বলাই বাহুল্য, এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান । বিরাট সমারোহে এটি অনুষ্ঠিত হত। মঙ্গলশঙ্খ, মদেঙ্গ, দম্পতি ইত্যাদি বাদ্য বেজে উঠত। এই পতে অনষ্ঠানে কাষায় বাধারী অথবা কোন বিকলাঙ্গ ব্যক্তির প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। পরে দিকে শক্লবর্ণ’, দক্ষিণে নীল, পশ্চিমে পীত ও উত্তরে রত্নবর্ণের অম্ল ভিত্তি প্রস্তরের নিচে রাখা হত দেবতাদের উদ্দেশ্যে। শিলান্যাসের কাজ রাত্রিতে সমাধা করার পর, সূর্যোদয়ের পণ্যে মতে ভিত্তি নির্মাণের কাজ আয়ত্ত হত। এই কিয়া সম্পাদনের জন্য আচার্য কে তিন দিন আগে থেকেই উপবাস’ থাকতে হত ।
ভিত্তি স্থাপনার পর হত স্তম্ভ স্থাপনা। প্রথমে পূর্বে দিকে শুভ্রবর্ণের গুপ্ত—যার নিচে রাখা হত শুভ্র বস্ত্রখন্ড দ্বারা জড়ানো স্বর্ণকিণা, দক্ষিণে নীল- বর্ণ শন্দ্রে গুপ্তের নিচে অনরূপভাবে রাখা হত লৌহকণা, পশ্চিমে পীতবর্ণের বৈশ্য গুপ্তের নিচে রৌপ্যকণা ও উত্তরে রক্তবর্ণের ক্ষত্রিয় গুপ্তের নিচে তাম্রকণা। এই ভাবে স্তম্ভের বর্ণ’ দ্বারা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের জন্য চিহ্নিত থাকত পৃথক পৃথক গ্যালারী। এগুলি ছাড়া আরো কিছু বেশি মঙ্গল- ভক্ত করার বিধানও ছিল। গুগুলি এমন ভাবে অবস্থিত হত, যাতে রঙ্গমঞ্চের কোন দৃশ্যে দেখার অসুবিধা প্রেক্ষকদের না হয়। বসবার আসনগুলি সিংড়ির মত মাটি থেকে ক্রমশ এক হাত উচুতে তৈরী হত ।

এরপর বর্ণিত হয়েছে রঙ্গপীঠ (মূল প্রদর্শন মঞ্চ) ও রঙ্গশী নির্মাণের বিধান। মহর্ষি’ ভরত রঙ্গপীঠ অপেক্ষা শীর্ষ রচনাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। রঙ্গপীঠ ও রঙ্গশীর্ষের ভূতুমি কালো মাটি দিয়ে সমতল ক’রে তার মেঝেতে নানা রকমের ধাতু, প্রবাল, মণি-মাণিক্য ইত্যাদি দিয়ে উজ্জল করে তোলা হ’ত। মেঝের পর তৈরী হত চার পাশের স্তম্ভ, দেয়াল, দরজা ইত্যাদি। গুপ্ত ও দেয়ালগালি সুসজ্জিত করা হত নানারূপে চিত্রাঙ্কন দিয়ে । রঙ্গ বা নাট্যমঞ্চপটি পাহাড়ের গুহার মত (র) এমন ভাবে তৈরী হত যাতে শিল্পী বা অভিনেতাদের কাঠমুরের অনরেশন হতে পারে।
রঙ্গশীর্ষে’র উত্তর পার্শ্বে থাকত মত্তবারণী (উইঙ্গ) এবং পিছন দিকে থাকত নেপথ্যগৃহ।
নাট্যশাস্ত্রে এই সব বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, ভরতের পূর্বেও উঁচু দরের নাটকাভিনয় হত এবং রঙ্গমঞ্চ ও নাট্যমন্ডপ নির্মাণ, সেকালেও কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্যান্য ধর্মীয় অনষ্ঠানের চাইতে অভিনয় লাকে কোন অংশে কম মনে করা হত না। নাট্যমণ্ডপের পূজায় ত্রিলোকের (স্বর্গ’, মত’, পাতাল ) সব দেবদেবীকে, সর্ব চরাচরকে আহ্বান জানিয়ে নমস্কার ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হত নাট্যানঠানকে সফল করে তোলার জন্য । রঙ্গপূজা সে সময় এমন এক সংস্কারে পরিণত হয়েছিল যে ঐ পূজো ব্যতীত নাটোর সাফল্য অসম্ভব বলে মনে করা হত।
রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজনীয়তা আজও কমে নি—বরং বেড়েছে।
আরও দেখুনঃ
