মূলভাব ও ধরন নাচের সাধারণ বৈশিষ্ট্য

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – মূলভাব ও ধরন নাচের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।

মূলভাব ও ধরন নাচের সাধারণ বৈশিষ্ট্য

 

মূলভাব ও ধরন নাচের সাধারণ বৈশিষ্ট্য

 

আদিম মানুষের চিন্তাধারায় কার্যকারণের প্রাকৃতিক সম্পর্ক অন্তর্ভূক্ত করার ক্ষমতা ছিল না। আদিবাসীগণ আত্মা ও দৈবশক্তি কল্পনা করে যা জীবনকে রহস্যময়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, ক্ষুধা এবং পরিতৃপ্তি জন্ম, রোগ এবং মৃত্যু যার ভৌতিক কার্যকলাপের প্রভাবে তাদেরকে আবাহন করে বা দূরীভূত করে।

মানুষ যাদুগ্রস্থ হতে পারে যখন অশরীরী, আবেগআপ্লুত, দৈনন্দিন জীবনত্যাগী দৈবশক্তি স্বাভাবিক জীবনপথ ছিন্ন করে এক লক্ষ্যশূন্য পথে আত্মচেতনা লুপ্ত করে অসীমে বিলীন হয়। গভীর আবেগ তাকে আত্ম-সম্মোহনের ক্ষমতা যোগায় এর সঙ্গে অতিমানবিক এক শক্তি তার প্রত্যহিক জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণ করে।

আবেগাপ্লুত, বিকৃত, অশরীরী হিংস্রতায় অথবা দেবত্বে রূপায়ন করা হয়। এই সব কিছুই প্রাণোচ্ছাসে সম্পাদন হয়। প্রতিদিন যা হারায় শুধুমাত্র-হর্ষ-উল্লাসেই পূর্ণ হয়। শুধু সেখানে আনন্দ, দুঃখ, ভালবাসা, রাগ, ভয়, ক্ষমতারদম্ভ, যেখানে ইচ্ছা ও চিন্তা রুদ্ধ এবং দেহ তাদের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হয়ে সবদিক থেকে প্রচলিত দেহভঙ্গি অতিরঞ্জিত করে অথবা তাদের ছন্দযুক্ত নাচে গাথে।

প্রত্যেক নাচ প্রাণোচ্ছাসপূর্ণ হয় ও আনন্দ দেয়। একজন যুবক বল রুমে তার বান্ধবীকে বাহুতে ঘিরে রাখলে এবং একজন শিশু রাস্তায় গোলক নাচে স্কিপিং করলে– তারা আত্মভোলা হয়ে যায়, প্রতিনিয়ত জটিল অস্তিত্বের মাঝে পার্থিব সম্পর্কের ভারসাম্য হারায়।

আদি মানবের প্রতিক্রিয়া কত অধিক তীব্র, তাদের হালকা মন অল্প প্রতিরোধের জন্য উদ্দীপনা দিতে পারে এবং তাদের শরীর বল্গাহীন বাড়ন্ত, বিশৃঙ্খল, বাধাহীনভাবে এই উদ্দীপনায় কত যে সাড়া দিতে পারে তা আমাদের কাছে অপরিচিত মনে হবে।

পর্যটকগণ বার বার রিপোর্ট করেন যে, আদিবাসীগণ নাচে আকার-ইঙ্গিত করে “যেন যাদুগ্রন্থ” খেঁচুনির মত তাদের শরীর কাঁপায়, সমস্ত শরীর এমনকি পায়ের অগ্রভাগ পর্যন্ত আন্দোলিত করে, তাদের চোখের তারা ঢাকা পরে, গলাদিয়ে বন্যপ্রাণীর ঘড় ঘড় শব্দ বের করে যতক্ষণ না নাচুয়ে মাটিতে লুটোপুটি খেয়ে অচৈতন্য হয়ে পরে। কালাহারী মরুভূমির বুশম্যানগণ বুয়র যুদ্ধের সময় “জ্যোৎস্না-নাচের” মাঝখানে প্রবল উত্তেজনাকর সময়ে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে দলকে দল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা পরে।

যদি কোন এক আত্মা আলোকিত জগতের কাছে সৌভাগ্যক্রমে পৌঁছতে পারে তবে আঁধার রাতের কোনে এক কালো অধ্যায়ের দ্বার উম্মোচিত হবার জন্যই যথেষ্ট হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উত্তেজনায় নাচুয়ের প্রধান সহায় যা প্রকান্তরে ধ্বংসাত্মক দিকে যায় এবং উৎপন্নের উৎসমুখের বাহন যে শরীর নাচুয়ে তা ছিন্নভিন্ন করে ফেলে।

বালির (ইন্দোনেশিয়ার এক দ্বীপ) ক্যাপাডোসিয়ান ‘মা’ মূর্তির সামনে পূজার জন্য হর্ষোৎফুল্ল নাচুয়েগণ প্রচন্ড উত্তেজনায় ঢোল, ট্রাম্পেটের তীব্র শব্দে শরীর থেকে রক্ত ঝরায়ে নাচতে থাকে। রাশিয়ার স্কপটিজ গোষ্ঠীদের গোলক নাচের উত্তেজনায় নিজে নিজে খোঁজা করতে রত হয়।

প্রায় এই সকল নাচ অকৃত্রিম ফকিরতান্ত্রিক হয়ে উঠে। ক্যালিফোর্ণিয়ার নেষ্টিনারি ও লুজিনোর বুলগেরিয়ান সম্প্রদায় আগুন-নাচে খালি পায়ে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে পদাঘাত করলেও আগুনে পুড়ে না। এমনকি উত্তর-পূর্ব ব্রাজিলের সমাজপ্রধান এবং সুদানের ভূতে-ধরা নিগ্রো নাচের গোলকে জ্বলন্ত কয়লা মুখে নেয়। একই ব্যাপার করে পুরান জার্মান বাসারকসগণও ।

এই নাচুয়ে সবাই বাস্তবিকই ভূতে ধরা। তাদের শুধু চেতনা রুদ্ধ হয় না- একটা আধ্যাত্মিকশক্তি, অপশক্তি, দেবতা তাদের শরীরে ভর করে এই রূপান্তর ঘটায়। এইভাবে, আদি মানব অপদেবতায় বিশ্বাসী হয়, রাশিয়ার খৃষ্টান ফেরকার খিলৃষ্টি ও মলোকানগণ যীশুখৃষ্ট হয়।

বিপরীতধর্মী কৃষ্টির দুটা উদাহরণ পাঠকদের এই অবস্থা আরো পরিস্কার করবে। মৌলিক কৃষ্টির জন্য আমরা ভেড্ডাদের বর্ণনা পরীক্ষা করতে পারি ঃ যাদুমন্ত্র যতই বার বার আওড়াতে থাকে ভানকারী তদ্রুত নাচতে থাকে, তার গলার স্বর বিকৃত হয়ে পরে সে ইয়াকু দ্বারা শীঘ্রই ভরপ্রাপ্ত হয় এবং যদিও সে জ্ঞান হারায় না এবং সে তার দেহভঙ্গির সামঞ্জস্য রক্ষা করে অথচ কখনই সে কি বলছে তা স্মরণে আনতে পারে না শুধু দেহভঙ্গির ব্যাপার আছে তবে আমরা বিশ্বাস করি এটা বশীভূত ভেড্ডাদের মধ্যে প্রচলিত।

শুধু ইচ্ছাকৃতভাবে দর্শকদের দেখানোর জন্য কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভেড্ডাদের মধ্যে গান ও নাচের দেহভঙ্গি তাড়াতাড়ি কমবেশী সহজাত অবস্থা উৎপন্ন করে যেখানে ভানকারীগণ ইয়াকুর বাস্তবতায় অনাগত ভরপ্রাপ্তি প্রাধান্য দেয়, সচেতন ইচ্ছাশক্তির বাইরে বাস্তবিকই প্রতিক্রিয়া করে।

বিভিন্ন স্থানের এই একনিষ্ঠ ভরপ্রাপ্তগণ আমাদের জেরার উত্তরে স্বীকার করে যে, তারা কখনই তাদের সম্পূর্ণজ্ঞান হারায় না, এক সময় তারা এইরূপ করে যা কখনই তার প্রশংসা করে না এবং ভরপ্রাপ্তির প্রথমে ও শেষে বিতৃষ্ণা ও ঘূর্ণিরোগের অভিজ্ঞতার উত্তেজনায় মনে করে পৃথিবী দুলছে পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে।

44 সলাও নিয়ার হান্ডুনা সহ কিছুলোক যাদের তথ্য আমরা খুবই বিশ্বস্ত বলে মনে করি তারা বলে যে, তারা ভরপ্রাপ্তির সময় সচেতন তারা শিহরীত ও আন্দোলিত হয়ে উঠে। হান্ডুনা যখন ভর থেকে মুক্ত হয়ে ওঠে এবং সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে পায় তখন সে নিজে গম্ভীর শব্দ শুনতে পায়।

নাচ ছেড়ে দেওয়ার পর এটা প্রায়ই এমন ঘটে– ভানকারী সত্যিকার অর্থে নাচের নিগূঢ় গভীরে একাত্ম হয়ে যায় এবং এটা সেই অবচেতন মনে অতি উচ্চাশার সঙ্গে মিশ্রিত হয় এবং অবশ্যই সতর্ক দূরদৃষ্টি ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী নাচের অংশ যা প্রচলিত প্রথামত সে সম্পূর্ণ রূপে স্বাভাবিক পথে সম্পন্ন করে”।

ওয়নয়ামওইজদের গুপ্ত সমাজ সম্পর্কিত কাজের বিভাগে উপ-জাতীয় কৃষ্টি থেকে একটা উদাহরণ স্থাপন করা যায় ঃ “যখন আমি সদস্যদের মধ্যে একজন যে নাচে অংশগ্রহণ করে না তাকে প্রশ্ন রাখলাম কেন নাচ করেনা, সে নির্বিঘ্নে স্বীয় বুলিতে জবাব দেয় নাটালি কুশানওয়ান ইসওয়েসি’ অর্থাৎ আমি এখনও ভরগ্রস্থ হই নাই অথবা আমি যাদুগ্রন্থের সাক্ষাৎ বা একাত্ম হতে পারি নাই।

একইভাবে প্রত্যেক ভক্তিআপ্লুত নাচে অংশগ্রহণকারি সদস্যগণ মাদুলী ও পদমর্যদা প্রতীক-চিহ্ন দিয়ে সজ্জিত করে নিজেকে ভরগ্রস্থ হয়েছে বলে বিশ্বসযোগ্য করে তোলে। সে আর নিজের কাছে থাকে না, যাদুগ্রস্থ শক্তি তার মাধ্যমে কথা বলে এবং তার সমস্ত সত্ত্বাকে পরিচালনা করে। সুতরাং তাদের সাময়িক উত্তেজনার সময় কোন মুসয়েজের সঙ্গে কাথা বলার উত্তর হবে বোধাতীত শব্দের, জরান এবং অস্পষ্ট বাক্যে। এমনকি সাধারণ অভিবাদন অর্থহীন এবং বোধাতীত বাক্যে পরিণত হয়।

আপনার মনে হবে এমন একজনের সঙ্গে কথা বলছি যে যাদুগ্রন্থের আশ্রয় থেকে রক্ষা পেয়েছে। কোন এক নাচের উৎসবে আমি একটা পুরাতন ধনুক হস্তগত করে তার মালিককে সঠিক মূল্য বলতে প্রলুদ্ধ করেও সাফল্য লাভ করতে পারি নাই। সে একটা জঙ্গলী আচরণের ভাব ধরে, খেত খেত থেঁত করতে করতে অস্পষ্ট ঢেউ খেলান শব্দ করতে থাকল যার থেকে এই পদবাচ্য উদ্ধার করা গেল যে “ওটা রাখ! দৈব্য-শক্তি নারাজ।”

অন্য ঘটনায় ইচ্ছাশক্তি এবং চিন্তা মোহাচ্ছন্ন সম্মোহনে লোপ পাওয়াই বৈশিষ্ট্য। তখন চোখ দুটাই বন্ধ থাকে, পা দুটা সোজা ছড়ান, ভাবগম্ভীর শান্ত এবং আত্মত্যাগ সাময়িক প্রচন্ড উন্মত্ততায় রূপ নেয়। এই পরিস্থিতির উদ্ভব করতে কৃত্রিমতার আশ্রয়ও নেয়া হয়। ইয়াপ দ্বীপে নেতা যাদুর ফর্মূলার সঙ্গে একজন মৃত ব্যাক্তিদ্বারা তাকে আরোপিত অলংঘনীয় গোপনীয়তায় প্রত্যেক নাচুয়েকে ঘুর্ণীয়মান, আঘাতকারী হাত দিয়ে সম্মোহীত করে।

বালি দ্বীপে একজন লেখক প্রত্যক্ষ করেন যে, মেয়ে নাচুয়েগণ সম্মোহীত ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পরে। ঘোর অন্ধকার-এখানে সেখানে বিক্ষিপ্ত আবছা ক্ষুদ্র আলোর শিখায় তেলের বাতি জ্বালছে। দুইজন কুমারী যুবতী হাঁটু গেড়ে ধোয়াচ্ছন্ন অগ্নিকুন্ডের সামনে বসে—তখন শুভ্রপেষাকে পুরাহিত বিড়বিড় করে মন্ত্র প্রার্থনা করতে থাকে এবং ক্রমাগত সুবাসিত ঔষধির টুকরা ও ফুল নিক্ষপ করে।

শ্যামলা নগ্ন একদল মহিলা যাদুবিদ্যা সংক্রান্ত একঘেয়ে সুদীর্ঘ মেলোডী গায় এবং প্রায় একটা একক চরণ অবিশ্বাস রকমের দীর্ঘ সময় ধরে পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। চূড়ান্ত পর্যায়ে একজন মহিলা একটা গর্তে যায়। পায়ের কাছে বলে আবোল-তাবোল বুদবুদ শব্দ করে বলতে বলতে সামনে পিছনে দুলতে থাকে। তাড়াতাড়ি তাকে সোনালী রঙ্গের জমকালো সাজে সজ্জিত করান হয়, পায়ে ঠুনঠুন করে এমন বালা এবং লম্বা আকর্ষণীয় সোনালী ফুলের মস্তকাবরণ পরায়ে তাকে মুক্ত সার্কেলের মাঝখানে নিয়ে যাওয়া হয়।”

অতীন্দ্রিয়-ধারা নাচে সংশ্লিষ্ট হয় যদিও অভিনয়ের মধ্যে শিল্পসম্মত নির্বাচন ও সমন্বয়ে যা আমাদের সাদা মানুষের কাছে মনে হয় কত সচেতন ও উচ্চ পর্যায়ের। উত্তর-আমেরিকা, মেলেনেশিয়া, মাইক্রোনেশিয়ার সমস্ত নাচ এবং নাচের সিরিজগুলি কল্পনা প্রবণ এবং পৃথিবীর চারদিকের সর্বত্রই নাচকে দৈব ক্ষমতায় আকরিত বলে চিহ্নিত করা হয়।

আজগবী কল্পনা ব্যক্তির বিচিত্র দেহ ভঙ্গি গঠন নিয়ন্ত্রণ করে কারণ ‘স্বপ্ন সচেতন কল্পনা বস্তুজগতের বাস্তবতা নিরীক্ষে চলমান হয়।” উল্লাস ও মোহনিদ্রার মত অতিমানবিক ক্ষমতা নাচুয়েকে অতি উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ধারণাতীত সময় পর্যন্ত অবস্থান করাতে পারে।

“নাচে দুর্বলরাও বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারে” সমস্ত রাতভর নাচ হওয়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ব্যাপার। গ্রান চ্যাকোর লেনগুয়াগণ নাচের সময় খায় যেটা ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকগণকে বিস্মিত করে, নাচের তালে তালে এমনকি মুখে তামাকের পাইপ ও মুখে রাখা হর্ষবর্ধক অপরিহার্য যন্ত্র বের না করে, দেহ ভঙ্গির পরিবর্তন না করে খাদ্য সামগ্রী মুখে পুরতে থাকে।

কিন্তু শুধু এই দেহ ভঙ্গিমায় এই উৎফুল্লতা কতক দিকে নিষ্ক্রিয়তা বয়ে আনে : যেমন ক্লান্তিতে ও অবসন্নতায় সমস্ত অনুভূতি লোপ পায় । সুতরাং পূর্বে একজন পর্যবেক্ষক ইন্ডিয়ান নাচের রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, “তাদের মাংসপেশী এত উত্তেজিত হয় যে, শেষ পর্যন্ত তাদের পা কে মনে হয় মাংসহীন একগোছা দড়ি ঝুলে আছে” মাত্র। ক্যালিফোর্ণিয়ান একোমউ মহিলা নাচুয়েকে ঋতুস্রাবের প্রথম দিকে এক নাগাড়ে পূর্ণ দশ রাত্রি নাচতে হয় এবং গ্রান চ্যাকো’র শুআইকুরূদের কোন পাণিপ্রার্থীকে তার ভাবী বধুর বাড়ীর সামনে আটদিন খেঁচুনিযুক্ত নাচ কাতে হয় ।

জার্মান লেখক জর্জ উলহেলম ষ্টেলার ১৭৭৪ খৃষ্টাব্দে তাঁর “Description of the country of Kamchatka” বইতে নাচ সমন্ধে সর্বোত্তম ভাষায় প্রকাশ করেন যে, “এই নাচগুলে যতই বন্য হোক এদের চিৎকার একদম বর্বরদের মত। নাচতে তারা এত ভালবাসে যে, একবার শুরু করলে মনে হবে উন্মত্ততা তাদের পেয়ে বসেছে। তারা থামতে পারে না। তাদের শ্রান্তি এমন হয় মুখমন্ডল থেকে ঘাম দর দর করে ঝরতে থাকে।

যে সবচেয়ে বেশী সময় ধরে রাখতে পারে সেটা তার বেশী সম্মান অর্জনে সহায়ক হয় তাতে যুবতী মহিলাগণ এগিয়ে এসে তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ঢঙ্গে কথাবার্তা বলতে থাকে। একবাক্যে তারা একঘন্টা নাচতে পারে এবং নাচের ঘের বা সার্কেল ক্রমান্বয়ে বড় হতে থাকে যত লোকজন তাতে ধরে ববং সবাইকে অবশ্যই যোগদান করতে হয়। চূড়ান্ত পর্বে থুর থুরে বৃদ্ধগণও শেষ শক্তি দিয়েও নাচের ভিড় করে। এই নাচ এক নাগাড়ে সন্ধ্যায় শুরু হয়ে পরদিন মধ্যাহ্ন পর্যন্ত পনের ঘন্টা ধরে চলে” ।

এখন নাচুয়েগণ শুধুমাত্র ছন্দবদ্ধ দেহ ভঙ্গিমায় উচ্ছাসজনিত ক্ষমতায় সম্পূর্ণ নির্ভরশীল না। ধূপ বা ধুনার ধূয়া এবং তামাক ব্যাপক প্রচলিত। উত্তেজক পানিয়র মধ্যে ম্যানডিওকা-বিয়ার, ভূট্টার বিয়ার, তালের রস, মধু-পানি মেশান মদ এবং ব্যান্ডি। অতি প্রাকৃতিক সাহায্য কোনভাবেই অবজ্ঞা করা হয় না : নিউগিনিতে নাচের পূর্বে পদযুগলে যাদু-পাথরের পাউডার ঘষা হয় ।

এই পয়েন্টে নাচ তার প্রচলিত সহজাত পথ থেকে সংকীর্ণ চোরাগলিতে পাড়ি দেয়। হর্ষোৎফুল্লতা, সক্রিয় পারর্ফমেন্স যার যার নিজস্ব স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, যাদু প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় উপাদান বলে বিবেচিত হয় না। উপরে উল্লেখিত ভাবে আসতে পারে যে, শারীরিকভাবে সক্রিয়তা এইসব দৃশ্যের আড়াল হয়ে নির্দিষ্ট নির্ধারিত দেহ ভঙ্গি একসঙ্গে প্রত্যক্ষভাবেই আকর্ষণ করে।

একজন শারীরিকভাবে নাচতে না পারলেও সে নাচে সহযোগী হতে পারে। ক্যালিফোর্ণিয়ার জুয়ানোদের মধ্যে কোন বালক সাবালকত্ব উৎসবে নাচে ক্লান্ত হয়ে পরলে বয়স্ক ব্যাক্তিগণ সার্কেলের মধ্যে এসে তাকে কাঁধে উঠায়ে নেয় এবং নাচে নিউগিনির পূর্বাঞ্চলে প্রথম ঋতুস্রাবের মেয়েকে অন্য সহযোগী মেয়ে কাঁধে তুলে নিয়ে আগুনের কুন্ডলীর উপর দিয়ে লাফায়ে পার হয়। সব মহাদেশে নাচুয়েগণ শিশুদের কাঁধে বহন করে। ক্যালিফোর্ণিয়ার ইউকাদের মতে “তাদের কাঠোর পরিশ্রমী করে গড়ে তোলা”।

আমাদের (জার্মান) লেভেলের সাংস্কৃতিতেও এই রকম প্রথার উদাহরণ আছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে নবজাতককে নিয়ে মোমবাতিকে ঘিরে নাচ করা হত। শেষ অবধি ১৯১৩ খৃঃ পর্যন্ত গীর্জার মার্সেলাস দিবসে বিরাট গণনাচে প্রোভেন্সের বার্জলসে মায়েরা শিশুদের উপরে তুলে সার্কেলে দোলা দিতে থাকে। রুমানিয়ান মায়েরা এখনও তাদের শিশুদের ক্যালিউসারীর বাহুতে রাখে। এটা তখন খুব আশ্চর্যের যে, ম্যাক্সিকোর মায়াগণ জন্তুদের সার্কেলে ছেড়ে দেয় এবং সুমাত্রার বাট্টাকগণ তাদের মৃত দল প্রধানের প্রতিকৃতি অবশ্যই নাচের সময় রাখবে ।

প্রতিষেধকরূপে— ঘড়িরকাটা উল্টা ঘুরায়ে— এই পবিত্র সাময়িক উত্তেজনা অসভ্যদের হৈহুল্লোরের জন্ম দেয়। অধিকন্তু এই ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণার নাচ ভাঁড়ামিতে নেমে আসে-যেন নাচের শিশু। (জার্মানদের র্নার (Narr) ভাঁড় সমজাতীয় শব্দ সংস্কৃত নটু (Nrtu’) বা নাচুয়ে?) আমেরিকার ইন্ডিয়ান থেকে ওসেনিয়া এবং এশিয়া পার হয়ে সুদূর ইউরোপে সে নাচে অংশ নেয় এবং প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে ।

সে অন্য নাচে অংশগ্রহণকারীদের ক্যারিকাচার (ঠাট্টা তামাসা) করে, দর্শকদের ভয় দেখায়, যুবতীদের টীজ বা উত্ত্যক্ত করে এবং জীবন-মৃত্যুর জটিল রহস্যে নিমগ্ন থাকে। চেয়ানি ইন্ডিয়ানদের খুলি-নাচে ভাঁড় হত্যাকারী শত্রুর পোষাক পরে এবং তিব্বতীদের ক্লোইসটার-নাচে দুই ভাঁড়ের পিছনে অন্য দুইজন খুলি বহন করে এবং সাদা আঁটসাট-পোষাক পরে যার উপর কংকালের ছবি আঁকা থাকে ।

ঐশ্বরিক শক্তির অনুপ্রাণিত নাচ পাশ্চাত্য জগতে দুস্প্রাপ্য হয়ে উঠে। কিন্তু এটার অন্য অংশ প্লে-ফেলো, বেল-রিংগিং ফুল, প্রিন্স কার্নিভাল, ভিলিনজেন হ্যানসেল, ইংরেজদের মরিস নাচে ভাঁড় এবং সেভিলের জিগানটোন বহু শতাব্দী ধরে জীবনের প্রাণশক্তি বিকাশে গভীর ভক্তি অর্জন করে আছে।

ডাইনোশিয়ান রণচন্ডির পবিত্র উন্মত্ততা নির্বাণ করা হয়েছে। কিন্তু ইউরোপের ভ্রাম্যমান আনন্দমেলার প্রাচীন তাৎপর্যপূর্ণ বর্ণনা আছে। সত্যি বলতে কি প্রাচীন পর্তুগীজ উদ্ভিদবর্ধন প্রক্রিয়ায় যাদুমন্ত্র করা হত যাতে একজন মুখোশ পরিহিত পুরুষ মেয়েদের মত পোষাক পরে যাদুগ্রন্থের মত উড়তে থাকে যার নাম ফলিয়াস অর্থ পাগলামী যা বর্তমানেও দেখা যায় ।

প্রাণী-জগতের নাচ বিশেষ করে বন-মানুষদের নাচে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মানুষের নাচের উৎসমুখ আনন্দঘন ক্রিয়া- প্রক্রিয়ার একটা খেলা যেখানে অতিরিক্ত শক্তি ছন্দবদ্ধ প্যার্টানে শক্তি যোগায়। কিন্তু এই ব্যাপারে মানুষের সঙ্গে অন্তর পার্থক্য এই যে, সে একই সময় অনুভব ও চিন্দ্র করতে পারে, সে তার ভূমিকার অর্থ, বিষয়বস্তু খুঁজতে চায় এবং তার ভূমিকাকে ভালভাবে অর্থপূর্ণ কর্মচঞ্চল রাখতে চায়।

ম্যাক্সিকোর প্রবীণ জুনী বলে “আমরা উভয় কারণে যেমন আনন্দ ও শহরের মঙ্গলের জন্য নাচি” । যখনই কোন ইচ্ছা মনে আকরিত হয় যে, খেলব বেড়াব সেটা কোন উদ্দেশ্য ছাড়া মনে হয়। কিন্তু নাচে উচ্চ বিন্যস্ত জীবন-ধর্মী (উপাদেয়) একটা সিদ্ধ পদ্ধতির রূপ নেয়।

আদিম মানুষেরা প্রতিটি অনুষ্ঠানে নাচে যেমন :- জন্ম, সুন্নত, কুমারী উৎসব, বিবহ, রোগ এবং মৃত্যু, দলপ্রধান উৎসব (অভিষেক), শিকার, যুদ্ধ, বিজয়, শান্তি চুক্তি, বসন্ত, ফসল কাটা এবং শুকর-উৎসব (শুকরের মাংস ভোজের) যদিও থিম বা বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ, লক্ষ্য সর্বত্র একই রকম, জীবন, ক্ষমতা, প্রাচুর্য ও স্বাস্থ্য। সুতরাং একই নাচ প্রায় অন্য সময় ব্যবহৃত হয়; অস্ত্র-নাচ বিয়ের-নাচের জন্য এবং কুমারী উৎসর্গের জন্য, লিঙ্গ-নাচ বৃষ্টি আবাহনের এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-নাচ অথবা সূর্য-নাচ রোগ নিরাময়ের নাচে ।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এই সকল থিম বা মূলভাব কোন এক রকম নাচে প্রকাশ পায় আবার অনেক সময় অন্য নাচে সম্পৃক্ত থাকে। এক সময় এক সঙ্গ নাচার জন্য ভিন্ন লিঙ্গের নাচের সমযাত্রীর প্রতি যৌনস্পৃহা জাগ্রত হয় অন্য স্থানে একদল পুরুষ একদল মহিলার প্রতি ধাবিত হলে, তৃতীয়ত আদি রসাত্মক দম্পত্তি বংশবৃদ্ধি কামনায় অভ্রান্ত ভঙ্গিতে ও অবস্থানে প্রকাশ পেলে এবং চুতুর্থত একক মহিলার সুডৌল দেহসৌষ্ঠব উগ্রসঞ্চলনে যৌন কামনার উদ্রেক করলে।

আমরা যুদ্ধ-নাচে দেখি একজন স্বাভাবিক চক্রাকার দেহ ভঙ্গিতে মৃত পূর্ব-পুরুষদের শোষণ নির্যাতন বঞ্চনার কাহিনী গেয়ে থাকে এবং অন্যদের মধ্যে দুইজনের কৃত্রিম আক্রমণ। এক জাঁকজমকপূর্ণ নাচের ধারা প্রবর্তিত হয়। অন্য আর্টের প্রতিনিধিগণ যে সকল শব্দ চয়ন করে তা পরিবেশন করে যেমন : ষ্টাইলইজম (প্রকাশভঙ্গিবাদী) আইডিয়ালিজম (আদর্শবাদী) রিয়ালিজম (বস্তুবাদী) ন্যাচারালইজম (প্রকৃতিবাদী) ।

যদিও পূর্ব থেকে এই রকম নির্ধারিত উদ্দেশ্যপূর্ণ মুখরোচক শব্দসমূহ পরিহার করা উচিত, মতবাদের এমত সেমতের সম্পর্ক মধ্যস্থ ছাড়া এই সকল শব্দের সব সময় অবশ্যই ভিন্নতর সংজ্ঞা হবে এবং যদিও হাতের কাছে পাওয়া তথ্যের বর্ণনায় একের পর এক নির্দিষ্ট ধ্যান-ধারণা নাচের কাঠামোর বিভিন্ন দিকের প্রয়োজনীয় মতবাদের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।

নাচের বৈচিত্রের মধ্যে নাচের কিছু ম্যাথডের দুটা থিম উদাহরণ হিসাবে উপরে উল্লেখ করা হয় যেখানে দেখা যায় যে, নাচ গঠনে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। একদিকে চক্ৰনাচে যেখানে বিশেষ বিষয় এবং উদ্দেশ্য পরিস্কার না—-একই নাচ একই দেহ ভঙ্গি উর্বরতা অথবা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ঘুরে, অন্যদিকে প্রকৃতির প্রতি দৃঢ়সংশ্লিষ্ট দেহ ভঙ্গি যেটা শুধু বিশেষ নির্দিষ্ট থিমে করা হয় দুটার মধ্যে মাঝখানে শ্রেণীবদ্ধ করে রাখা কঠিন বিশেষ করে যেটা থিমের রূপক অর্থ ইঙ্গিত করে, তারচেয়ে অবস্থান, গেচার এবং অলঙ্কার দ্বারা শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির প্রতি বিশ্বাস হারায়। শুধুমাত্র এই এক বা দুই সম্ভাবনার মধ্যে কিছু থিম জুতসই ধরা যায় । এই তিন ধারার যে কোন একটাতে অধিকাংশের অবস্থান্তর প্রকাশিত হয় ।

নাচের মাধ্যমে অভিপ্রায় হাসিলকারী প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট রাখা সমবৃষ্টির গোষ্ঠীকে পরিস্কার ও সহজে চিহ্নিত করা যায়। এই রকম নাচে যে ঘটনা প্রত্যাশা করা হয় শেষে তাই কামনা করা হয় এবং এইরূপে ঘটনাকে জোর করে সেই পথে চালিত করে সমাপ্ত করা হয়।

এই নাচের জীব-জন্তুর বৃদ্ধি যা মানুষের জীবন ধারণে অপরিহার্য, মৃগয়া ধাবন খেলার শেষ, শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ জয়, ভাল ফসল, মৃত্যু এবং পুনরুত্থান বর্ণনা করা হয়। সুতরাং এটাকে আমরা কাল্পনিক অথবা মূখ-নাচ হিসাবে নামকরণ করতে পারি।

মূখাভিনয়ের সঙ্গে বৈপরীত্যময় যে নাচ সেটা একটা ক্রীয়াশীল ধারণা, একটা নির্দিষ্ট ধর্মীয় লক্ষ্য, মূখাভিনয়ের প্রহসন, অনুকরণহীন ঘটনা, ফরম, জীবনের গেসচার এবং প্রকৃতি যোগান দেয়। যেটাকে আমরা কল্পনা হীন অথবা বিমূর্ত নাচ বলতে পারি। এটা শুধুমাত্র হর্ষোফুল্লের দিকে লক্ষ অথবা আধ্যাত্মিক গোলক ধাঁধাঁয় আকরিত হতে থাকবে যেখানে সর্বময়তা বাহিরে ভিতরে আসা-যাওয়া করে অথবা অন্তরে বাহিরে অবস্থান নেয়।

২য় শতাব্দীর গনেষ্টিক স্তোত্র আমাদেরকে এক প্রাণবন্ত ক্ষমতার স্রোতের ধারণ দেয়। পাসোভার ভোজ-উৎসবের পর তাঁর লক্ষ্যস্থানে পৌঁছাবার পথে যীশু তাঁর ভক্তদের আদেশ করেন যে, তোমরা হাতে হাত ধরে তাঁর চারদিকে গোল হয়ে নাচ।

এই পবিত্র মিলনে তিনি তাঁর শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করেন “আমার নাচের এখন কি উত্তর তুমি দাও। আমার ভেতরে কে কথা বলে প্রভু।” এই প্রতিধ্বনি অন্যের মধ্যে এত স্বচ্ছ ফরমে (আকৃতি) আছে যে, এই রকম সর্বত্রই একই অর্থে কল্পনা হীন নাচের উৎসমূলে অবস্থান করে থাকে ।

সাবলিকাগণ নতুন বয়স্কদের ঘিরে ঘুরে এই জন্য যে, সেও গোষ্ঠীর একজন সুযোগ্য উৎপাদন সমৃদ্ধ সদস্যে রূপান্তরিত হবে। বিবাহিত মহিলাগণ নতুন বিবাহিতদের ঘিরে নাচে তাদের নিজেদের শ্রেণীভুক্তিতে অভ্যর্থনা করার জন্য, আরো শত্রুর মাথার চার পাশ ঘিরে, উৎসর্গীকৃত মহিষ, বেদী, সোনালী বাছুর, পবিত্র পাতা ইত্যাদি ঘিরে নাচে এই বিশ্বাসে যে, এই সমস্তের নিগূঢ় শক্তি তাদের প্রতি রহস্যজনভাবে ভর করতে পারে। সর্বদা এটা একটা প্রশ্ন থেকে যায় “আমার মধ্যে কে” ।

কল্পনা প্রবণ ও কল্পনা হীন নাচের গঠন-প্রকৃতিতে পরিস্কার পার্থক্য বুঝার যায়। যদি গঠন প্রকৃতি ও দেহ ভঙ্গি থিমের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গি জড়ায়ে দাঁড়ায় এবং সত্যিকারভাবে এ ঘটনা বর্ণনাক্ষম হয়, যদি তারা সংশ্লিষ্ট ঘটনাকে অতি সাধারণ এবং পরিবর্তন করে তখন অনুকরণাত্মক এবং কল্পনা হীন নাচ ছাড়াও এটাকে আমরা রূপক ও আক্ষরিক নাচ বলতে পারি। সূচনা-নাচ রূপক হতে পারে যার থিম নতুন শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাত করে ক্ষমতা বৃদ্ধি বুঝাতে পারে।

লিঙ্গ-নাচের রূপক হতে যেখানে পুরুষগণ মাটি সজোরে আঘাত করলে মহিলাগণ প্রতি-উত্তরে প্রত্যেক শব্দে বিকট চিৎকার করতে পারে। বিয়ে- নাচ, অস্ত্র-নাচের বৈশিষ্ট্যের মত রূপক হতে পারে। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে আমরা “রূপকঃ এবং “ আক্ষরিক” শব্দ ব্যবহার না করে অবশ্যই ভাল করতে পারি।

শুধুমাত্র আধুনিক ও পাশ্চাত্য চিন্তাধারার ক্ষেত্রে তারা সম্পৃক্ত। আদিম জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তাদের প্রয়োগ জন্য বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন। মধ্যস্থতা করার জন্য এটা সবচেয়ে ভাল যে, সমস্ত নাচে সাধারণ বৈশিষ্ট্য না থাকলে একশ্রেণীভুক্ত বলে চিহ্নিত করার চেয়ে তৃতীয় ধরনে অবস্থান না নিয়ে দুই বিপরীত প্রান্তে সমর্থন করা। অন্য একই ধারার নাচ থেকে পার্থক্য করা খুব সহজ না।

কিন্তু এটা আমাদেরকে তেমন কষ্টকর অবস্থায় ফেলতে পারবে না। জীবন কোন গভীর সীমান্তরেখা জানে না এবং আমরা কোন কিছু জীবন্ত প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা সর্বোকৃষ্ট সীমানা নির্ধারণ করতে পারে।

বন-মানুষ পর্যবেক্ষণ করে আমাদের চিন্তা প্রসারিত হয়েছে যে, “কল্পনা হীন” নাচ প্রথম উদ্ভব হয়, যাকে পরে নকলকারক অনুকরণকারী অনুসরণ করেছে। নিঃসন্দেহে আমরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের তীব্র মতভেদ পাই যে, ইউরোপের পুরাতন প্রস্তর যুগের এবং সর্ব নিম্ন শ্রেণীর কৃষ্টির অধিবাসীগণের মধ্যে কল্পনা প্রবণ ও কল্পনা হীন নাচের জীবনযাত্রার বহু প্রমাণ বর্তমানেও পাওয়া যায় ।

এমনকি সভ্যতার প্রাথমিক কালে উভয় রকম নাচ পাশাপাশি দেখা যায়। দুই বিপরীতমুখী বিষয় নিয়ে আমরা চর্চা করি সেটা আমাদের অনুভূত হয়। সময়ের বিবর্তনে এটা পরিস্কার হয়ে উঠে যে, তারা প্রত্যেকে সীমা অতিক্রম করেছে কিন্তু কেউ কারো থেকে উৎপন্ন হয় নাই। ধারণের দিক থেকে তারা সম্পূর্ন ভিন্ন। বহির্বিশ্বের পর্যবেক্ষণ থেকে একজনের উৎপত্তি হয়েছে।

একটা প্রাণী দেখতে কেমন? কেমন করে চলে? কেমন করে মাথা নাড়ায় এবং ডানা মেলে? কেমন করে সামনে লাফায় ? কেমন করে একজন অন্যকে নকল করতে পারে? এই নকল নাচ মিওলিথিক পর্বতগাত্রে অংকিত চিত্রকলার মত শান্ত- যা চাক্ষুষ ভাবে উৎপন্ন ! আধুনিক মনস্তাত্বিক ডঃ জাংগ যাকে বলেন বহির্মুখী চিন্তাধারা অন্যদিকে কল্পনা হীন নাচ সম্পূর্ণভাবে উৎপত্তিগতভাবে অ-সংবেদজ এবং ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সাধিত।

উৎপত্তিগতভাবে কোন চিন্তা কোন ফরম এবং ভঙ্গিমা অনুকরণ করে না। কোন বস্তুকে ঘিরে নাচুয়ে নাচলে তার দৈবশক্তি নাচুয়ের উপর ভর বিস্তারে জন্য যাদুক্রিয়া ভীষন চেষ্টা করে অথবা উল্টা কিছু হতে পারে। জীব-জন্তুর বহির্মুখী নাচের বিপরীতে এটা সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে, এটা অন্তর্মুখী নাচ ।

বহির্মুখী এবং অন্তর্মুখী শব্দ দুটি সাম্প্রতিককালে মনোবিজ্ঞান থেকে সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হচ্ছে। পিতৃপ্রধান পরিবারের সদস্যগণ বহির্মুখী এবং মাতৃপ্রধান পরিবারের সদস্যগণ অন্তর্মুখী হয়। এদের মানসিক অবস্থার উপর সামাজিক বৈচিত্রময় সম্পর্ক বর্ণনা করা যায় যেটা এই মৌলিক পার্থক্যগত কারণে মানসিক মনোভাব গঠনে ভূমিকা রাখে। এইভাবে নাচকে আমরা প্রয়োজনের মুখে এক অনিশ্চিত জগতে নিয়ে গেছি যেখানে মানবজীবনের নিগূঢ় দ্বন্দ্ব সংঘাত প্রচ্ছন্ন।

আপাতঃদৃষ্টে এই পার্থক্য খুব কম নির্ভরশীল। এক ক্ষেত্রে শিশু পিতার পরিবারের অধিকারে থেকে পিতার অধীনস্থ থাকে, অন্যদিকে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে শিশুর মামা অভিভাবক এবং রক্ষাকারী হয় যদিও পিতার কোন মূল্য থাকে না। বর্তমানে ইউরোপ পিতৃপ্রধান।

স্ত্রী স্বামীর উপাধি বা নাম ধারণ করে স্বামীর অভিভাবকত্বে থাকে। মাতৃপ্রধান পরিবারের অতি পরিচিত উদাহরণ আমরা পবিত্র বাইবেলের প্রথম বইতে পাইঃ হ্যাজার, লেহ্ এবং রাসেল-পিতা না তাঁদের ছেলেদের নাম।

এই সমাজবিজ্ঞানের লেভেলের পিছনে সেখানে প্রচুর সংখ্যক বিপরীত ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় এবং নৈতিক উপলদ্ধি, অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান আছে; পিতৃপ্রধান অঞ্চলে দেহশক্তির প্রচুর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়-প্রচন্ড অস্থির প্রকৃতি, যাযাবর প্রবণতা, পশুপালন, সূর্য-পূজা, অন্যদিকে মাতৃপ্রধান সমাজে, নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যের প্রচুর প্রভাব-উৎফুল্লতা, শান্ত প্রকৃতি, স্থির, গাছ লাগান, পূর্ব-পুরুষ এবং চন্দ্র-পূজা।

এই সকল বৈপরীত্য একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে পাশাপাশি থাকতে পারে। আবার বিভিন্ন ধরনের লোকের মিশ্রণে থাকতে পারে তবে এটা তার কতটুকু মিশ্রণ হয়েছে যেটা তার উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে সেটার উপর নির্ভর করে। যখন আমরা নিজেরাই এই বৈপরীত্যের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পরি, লক্ষ্য স্থির করার প্রয়োজনে আমরা অবশ্যই পিতৃ বা মাতৃপ্রধান চিন্তা-চেতনা ব্যবহারে আর কোন উপযোগীতা পাই না।

সমাজ-বিজ্ঞানের দিক থেকে বৈপরীত্য খুব কমই আমাদেরকে ভাবায় এবং আমরা যদি সেখানে থেমে থাকি তবে আমরা কদাচিৎ লক্ষ্যে পৌছতে পারব। সবচেয়ে আদিম সম্পর্ক সমাজ-চিন্তার নির্দিষ্ট পারিবারিক শ্রেণীবিন্যাসের স্তরে পৌঁছতে পারে নাই যখন ঝোঁক, ধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি এই বিভাগের প্রাথমিক স্তর পূর্বেই গঠন করেছে।

আমাদের কাজ খাঁটি বুদ্ধিজীবীদের বৈপরীত্যের মধ্যে অগ্রসর হওয়া এবং কল্পনা হীন ও কল্পনা প্রবণ নাচের মধ্যে বৈপরীত্য কতটুকু পরখ করা। পূর্বোক্তটি মনোবিজ্ঞানী দ্বারা নিম্নরূপে নির্ধারিত ঃ

মাতৃপ্রধান

অন্তর্মুখী

পিতৃপ্রধান

বহির্মুখী

শরীর থেকে স্বাধীন

শরীরের মধ্যে আবদ্ধ (দেহাবদ্ধ)

কল্পণা প্রবণ

বিমূর্ত কল্পনার অধিকারী

সংবেদজ

অভিজ্ঞতালদ্ধের অধিকারী

উভয় নাচের বৈশিষ্ট্যে এই রকম সাজান গুণাবলী পরিলক্ষিত হয় যা কেউ অস্বীকার করে না। কল্পনা প্রবণ নাচ “দেহাবদ্ধ” হয়। কল্পনার চলন ও অবস্থান একটা শক্তিকে ধারণ ও প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম এই ধারণা থেকে এই নাচের শুরু। “বহির্মুখী বৈশিষ্ট্য তাকে ঐ বস্তুর উপর একভাবে প্ররোচিত করে এবং তার সঙ্গে একাত্ম হতে বলে” । কোন জন্তুর প্রতিকৃতি করা মানে সেই রকম একটা হওয়া।

“কিন্তু যখন আমরা এই ইচ্ছাশক্তি অন্য বস্তুর উপর প্রতিক্রিয়াশীল করতে চাই, আমরা তখন অন্য বস্তুর একটা অংশ বিশেষ” । এই রূপে আমরা জীব-জন্তুর উপর বিজয় লাভ করি। পশ্চাতধাবন শিকারী খেলার ভাগ্যলাভ করে, জমির উর্বরত (অধিক ফসল কামনা) যৌন সম্ভোগ প্রতিনিধিত্ব করে।

কল্পনা হীন নাচ “শরীর থেকে স্বাধীন” থাকে। এটার ভঙ্গিমার লক্ষ্য অভ্যাসগত দেহ সংশ্লিষ্টতার বাইরে শরীরকে উত্তোলন করা যতক্ষণ না বাহ্যিক জ্ঞান হারায়ে অবচেতন মন মুক্ত হয় এবং দৈবশক্তি বৃদ্ধি পেয়ে মোহাবিষ্ট স্তরে আরোহণ করে। মোহাবিষ্ট নাচুয়ে তার শারীরিক ভারসাম্য হারায়ে ভরপ্রাপ্ত হতে চায়। আত্মচেতনা হারায়ে অঙ্কুরিত ধারণাকে আকৃতির

লক্ষ্যে সে কাজ করে : যে বৃষ্টি সে আবাহন করে তা কোন পাত্রে পানিপূর্ণ আকার পাবে না, অথবা লিঙ্গ-নাটকে (লিঙ্গ- পূজা) উর্বরতা অথবা তলোয়ারের ঝনঝনানিতে বিজয় পাবে না। এই দুই বৈশিষ্ট্যের নাচ তাদের তীব্র বৈপরীত্যে বিদগ্ধ স্তরে প্রবেশ করে যেখানে প্রচন্ড এবং অবিচ্ছন্ন দ্বন্দ্বে মানব জাতির কৃষ্টি নিরূপণ করে । এই ব্যাপারে সময়ের কোন প্রশ্ন অবান্তর ।

এই দুই তীব্র, চওড়া মধ্য লাইনের যোগাযোগ আরো অধিক স্পষ্ট আলোকে প্রতিফলিত হবে। কল্পনা হীন নাচের “বাস্তবায়ন” কল্পনা প্রবণ নাচের “আদর্শায়ন” এর সঙ্গে যুক্ত হয়। এই রকম ঘটনাও ঘটে যে, মোহগ্রস্থ বৃষ্টি নাচুয়ে জ্বলন্ত আগুনের চেয়ে এক পাত্র পানি নাচের মাঝখানে রেখে ঘোরে ও পান করে অথবা ইন্ডিয়ান সূর্য-নাচুয়ে নাচের মাঝখানে উঁচু খুঁটিতে সূর্যের প্রতিকৃতি ঝুলায়ে চারদিক ঘিরে আগ্রহের সঙ্গে নাচে।

এই সকল মৌলিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন আমাদেরকে অবিচিছন্ন রূপান্তরের মাঝে ঠেলে দেয় যার কারণ সর্বদা আগ্রাসন এবং স্থানান্তর, এই দুটা বিরাট কৃষ্টির ধারার গঠন প্রকৃতি । প্রতিবেশী গোষ্ঠীর মধ্যে সঙ্কর প্রজনন মানুষ ও চিন্তার স্থানান্তর এই কারণে চিহ্নিত। সুতরাং আমরা কদাচিং কোন জনগোষ্ঠী পাই যে, তার শুধু মাত্র কল্পনা প্রবণ বা কল্পনা হীন চিন্তাধারায় সীমাবদ্ধ ।

যেমন আমরা সাক্ষাৎ পাই না বাদ বাকী পিতৃতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বৌদ্ধিক বা পার্থিব রাজ্যে একবারে অকৃত্রিম প্রকৃতিতে বিরাজমান আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চতর বৈশিষ্ট্যের কৃষ্টির বিজয় স্বতঃসিদ্ধ এবং এটার সঙ্গে নাচ অবশ্যই অঙ্কুরিত ব্যক্তিত্বের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হবে এবং সমাজে শ্রেণী-বিভাগ প্রকটতা পাবে।

এমনকি বাহিরের কোন রকম প্রভাব ছাড়াই নাচকে সমস্ত মানবিক বিধি-বিধান ও আকৃতিগত অস্তিত্বের ভাগ্যবরণ করতে হবে ঃ

এটা নবরূপ ধারণ করে; যে আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব ক্ষমতা এটার সৃজনশীলতায় উৎসারিত ও ধারণ করে তা দূর্বল হয়ে পরে, যে বিশ্বাস এটাকে পরিতৃপ্ত ও গঠিত করে ধর্মীয় বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তা বন্ধ্যা, কুসংস্করাচ্ছন্ন জগতে পথ হারাতে বাধ্য হয় যদিও মৃত এবং জড়, শরীরিক কর্মে প্রফুল্লতা, স্বচ্ছন্দ গতিবেগ, জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ক্ষমতা এবং যৌন স্বাধীনতা এটার মধ্যেই নিহিত।

 

 

মূলভাব ও ধরন নাচের সাধারণ বৈশিষ্ট্য

 

এইরূপ এটা বৃহত্তর পরিসরে বর্তমানকালে যেভাবে বিদ্যমান একইভাবে প্রাক্-ঐতিহাসিক কালে আদিম সভ্যতায় আনন্দঘন শিল্পবস্তু এবং সামাজিক আমোদফূর্তির উপলক্ষ্যে বিরাজমান।যখন থেকে মৃত এবং জড়ধারা সম্পূর্ণ শুকায়ে না যাবে ততক্ষণ নতুন কোন ক্ষমতার উৎসমুখ এতে প্রবাহিত হবে না।

পুরাতন আকৃতি ও ভঙ্গি সহজ এবং সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যে, পাথর-যুগ থেকে আজ পর্যন্ত নাচ খুব কমই নতুন আকৃতি এবং নতুন বিষয় গ্রহণ করেছে। সৃজনশীল নাচের ইতিহাস বলে প্রাক্-ঐতিহাসিক সময়েই সৃজনশীল নাচ সৃষ্টি হয়েছে ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment