আজকে আমরা কথক নৃত্যের ক্রম বা সপ্তপদার্থ সম্পর্কে আলোচনা করবো।

Table of Contents
কথক নৃত্যের ক্রম বা সপ্তপদার্থ
আপনারা জানেন, কণ্ঠসংগীত ও তন্ত্রবাদ্য পরিবেশনের কিংবা একক তবলা বাদনের সময় শিল্পীরা একটি ক্রমবদ্ধ নিয়ম অননুসরণ করেন । কথক নৃত্যে প্রদর্শনেরও তেমনি ক্রমিক পদ্ধতি আছে । আজকাল অবশ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই নিয়ম পালিত হয় না। ফলে নৃত্যে শিক্ষার্থীদের তথা ননৃত্যপ্রেমীদের কাছে বিষয়টি ভ্রান্তিমূলক মনে হয়। পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সব বিছরে মতই নতোর মধ্যেও অনেক পরিবর্তন এসেচে পরে স্বাভাবিক ভাবেই।
তেমনি আসর বেেঝ মানে দর্শকদের রচি, সময় ও দৈব’ প্রভৃতির দিকে লক্ষ্য রেখে কোন, আসরে কতটুকু নতো প্রদর্শন করা প্রয়োজন, সেই বুঝে নতোর অংশ বিশেষ দেখানো হয়ত খুব দোষাবহ নয় কিন্তু এমন আসরও আছে যেখানে নাতোর বিশিষ্ট পূর্ণ ও সমঝদার দর্শকেরাও উপস্থিত থাকেন। সময়ও যেখানে নেহাৎ কম দেওয়া হয় না। সেখানেও যদি কমবদ্ধ ভাবে সম্পূর্ণে নতো প্রদর্শিত না হয়, তাহলে ভালো নেচেও যথাযোগ্য প্রশংস পাওয়া যাবে না গণেীদের কাছ থেকে।

আমরা দেখেচি, ঘরানা হিসেবে প্রদর্শন-পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা হেরফের হয়ে থাকে। যেমন-
লখনৌ ঘরানার নৃত্য ক্রম
এখনো ঘরানার শিল্পীরা রঙ্গমঞ্চের পটোত্তলনের পূর্বে নেপথ্যে ‘বন্দনা’ ক’রে নেন । তারপর পর্দা ওঠার পর একে একে প্রদর্শন করেন- ঠাট, রঙ্গমঞ্চ-তোড়া, আমদ, ভেড়া, টুকড়া হুংকার-টুকড়া নাচ- টুকড়া, পাশ, পরমেল, বা প্রিমল, পায়ের কাজ, তৎকার, গৎ, নিকাস, গৎ-নিকাস – চা ভাও ইত্যাদি ।
লখনৌ ঘরানার একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, তাঁরা যখন কবিতা বা দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন, তখন দাঁড়িয়ে নাচেন না। তাঁরা বলেন, দেবদেবী সম্বন্ধীয় কোন শব্দ পাদ-বিক্ষেপের দ্বারা প্রদর্শিত হওয়া উচিত নয়। তাই তাঁরা এই অংশগুলির ভাব-অভিব্যক্ত করেন উপবেশন অবস্থায় । এই ঘরের নৃত্যে প্রধানত মন্দিরের উপযোগী। তাই এরা কথক নতাকে ‘নটবরী নাত্য’ নামে অভিহিত করেন।
জয়পুর ঘরানার নৃত্য ক্রম
জয়পুরে ঘরানার নৃত্যে প্রধানত দরবারী নৃত্যের পর্যায়ে পড়ে। এই ঘরের শিল্পীরা নৃত্য আরম্ভ করেন ঠাট দিয়ে। তারপর রুমানাসারে দেখান—সলামী, আমদ, তোড়া, টুকড়া, কবিতা-পরণ, পরণ, নিকাস, তৎকার। উভয় ঘরানাতে প্রথমেই বোলগুলি মুখে আবৃত্তি করে শোনান হয়, পরে সেইগুলি দেখান হয় নেচে ।

সপ্তপদার্থ
এবার দেখুন ‘সম্প্রপদার্থ” নামে যে নাম, তার পরিচয়-
১। ঠাটঃ
প্রথমে অভ্যাগতদের মানে দর্শকদের সামনে এসে তাঁদের অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়াতে হয়। সংঘেরের মত নভোবস্তরে ভূমিকাও আপন করা হয় এই সময় ।
২ । সলামীঃ
অভ্যাগতদের প্রণাম করা।
৩। আমদঃ
প্রণামান্তে অভ্যর্থনার জন্য অগ্রসর হওয়া। এই অঙ্গে “ঘন ঘন” শব্দের প্রয়োগ অনিবার্য। সমাগত দর্শকদের গোলাপজল ইত্যাদি সুরভি দ্বারা আপ্যায়ন করার প্রতীক হ’ল এই ক্লিয়াটি।
৪। নৃত্য-অংগঃ
ঘরানার বৈশিষ্ট্য অননুসারে তোড়া, টুড়া, পরণ ইত্যাদি সবগুলি মিলিয়ে কথক নাতোর পরিভাষায় একটি “পিন্ডি’ রচিত হয় এই অঙ্গে। নত্তে অঙ্গের এই প্রথম ‘পিণ্ডির বৈশিষ্ট্য, বোলা, লিকে নানা লয় ও ছন্দে সাজিয়ে পদ্যগেলের দ্বারা সেগুলি প্রকাশ করা। এই সময়ে যে হস্ত-বিক্রেশ করা হয়, তা’র কোন অর্থ থাকে না। সেইজন্য এগুলিকে ‘মা’ না বলে, বলা হয় ‘হক’। কোন কোন ঘরানায় ( যেমন লখনৌ ) নৃত্যোঙ্গের বস্তুও দেখানো হয়। সে সময় অবশ্য ‘মাদ্রারও প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় ‘পিন্ডি’ হল নৃত্যঙ্গের । যেমন-
৫। গৎভাওঃ
মাদ্রার প্রাধান্য, বিভিন্ন ভাবের অভিব্যক্তি, নৃত্যোঙ্গের গং-তোড়া ও নাটা অঙ্গের কাহিনী। দ্বিতীয় ‘পিন্ডি’র বস্তু প্রদর্শনের পর পনেরায় প্রথম ‘পিডি’তে — অর্থাৎ নত্তে অঙ্গে ফিরে আসতে হয়।

৬। তৎকারঃ
গৎভাও-এর পরবর্তী রুম হ’ল তৎকার । তৎকারের নির্দিষ্ট বোল নিয়ে, যেমন “তা থেই, পেই তৎ” ইত্যাদি দিয়ে—নানা লয়কারী ছন্দ ও তৈয়ারী’ দেখান হয়।
উপরোক্ত ছটি বিষয় প্রদর্শনের সময় বিশেষ লক্ষণীয় এই যে, প্রথমে যে লয়ে আরম্ভ করা হয়। ধীরে ধীরে সেই লয় বাড়তে থাকে। শেষ করা হয় অতি পুত লয়ে । অনেকে এই লয়কে বলেন ‘সুলপ’ লয় ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আজকাল এক-একটি বিষয় ( item) প্রদর্শনের পর লয় ভঙ্গ করা হয়। নাত্যগণেীদের মতে এটা রীতিসম্মত নয়। এই ছ’টির পর বিরাম। বিরামের পর আবার শুরু হবে ৭নং ক্লিয়া থেকে।
৭। হেলাঃ
এটিও তৎকারের মংখ্য অঙ্গ। এই অংশে কোন গান গেরে তা’র ভাব প্রদর্শন করা হয় নানা দেহভঙ্গি দ্বারা। এই অঙ্গের প্রদর্শন কেউ বসে বসে করেন, কেউ বা দাঁড়িয়ে তোড়া সহযোগে ঘুরে-ফিরে দেখান এই অংশে প্রদর্শিত ভাড়া, কড়া প্রভৃতিকে ” ” কোন বাধ্যবাধকতা নেই কিন্তু এখানে ‘চারী’ অবশ্য করণীয় ।
‘হেলা’র পর কথক নৃত্যের পরিসমাপ্তি ঘটে। এই সাতটি ক্রমের সমন্বরকে বলা হত ‘সপ্তপদার্থ”।

সপ্তপদার্থ
সপ্তপদার্থ’-এর বিষয়-বস্তু নিয়ে মতভেদ আছে। একটি মত ওপরে বর্ণিত হয়েছে । অপর মতটি নিম্নরূপে।
এই মতে বেশভূষা, মদ্রা, করণ, অঙ্গহার, কাহিনী (হিন্দীতে যাকে বলা হয় ‘কথানকা’ ). গৎ ও মাল—এই সাতটি পদার্থ’কে বলা হয় ‘সপ্তপদার্থ” । এগুলির মধ্যে ছ’টির বর্ণনা পারে আলোচিত হয়েছে। বাকি রইল ‘মान’।
নৃত্যের সময় যখন ডাইনে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে ওপরে-নিচে নানাভাবে – হস্ত সঞ্চালনের দ্বারা নিম্নোক্ত বিষয় বাস্ত করা হয়, সেই বিশেষ ইঙ্গিতবহ হস্তসঞ্চালনকে বলা হর ‘মাল’। ‘মাল’-এরও সাতটি প্রকারভেদ আছে। যেমন-
১। বিষ্ণুমালঃ
বিষ্ণু ভগবান এক। এই অদ্বৈতবাদী ইঙ্গিতকে বলা হয় বিষ্ণুমাল।
২। জীবমানঃ
জীবের মধ্যে দুই আত্মার আস্তিত্ব আছে। একটি জীবাত্মা অপরটি পরমাত্মা। এই বিষয়টি বোঝানো হয় ‘জীবমাল’-এর ক্লিয়ার দ্বারা।
৩। গুণেমালঃ
গুণ তিন প্রকার । — সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ ।
৪। যুগমালঃ
সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি–এই চার কাল বা যুগ ।
৫। তত্ত্বমালঃ
ক্ষিতি ( পৃথিবী ), অপ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু) ও ব্যোম (আকাশ )—এই পাঁচটি তত্ত্ব।
৬। ঋতুমালঃ
ছয় ঋতু গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত
৭। লোকমালঃ
ডঃ ভবঃ, সঃ, মহঃ জনঃ তপঃ ও সত্য প্রভৃতি সাতটি লোক বা জগৎ।
এই প্রসঙ্গে প্রয়াত প. শভ মহারাজ বর্ণিত কথকের সাতটি অবয়বের উল্লেখ করা যেতে পারে। জানিনা, এই ‘সাতটি অবয়বকে তিনি ‘সপ্তপদার্থ রূপে বর্ণনা করেছেন কিনা। কারণ, তাঁর গ্রন্থে ‘সপ্তপদার্থ’ নামে কোন পরিভাষা নেই, শষে, সাতটি অধঃবেরই উল্লেখ করেছেন। সাঙ্গীতিক পরিভাষায় এত মতভেদ আছে যে, তা’র মধ্যে কোনটি ঠিক আর কোনটি বেঠিক বলা শত। শিক্ষার্থীদের পক্ষে নিজ-নিজ নভোগকর নির্দেশ অনুসরণই বাঞ্ছনীয়।
এবার দেখুন সাতটি অবয়ব কি—১। থাট বা লক্ষণ নৃত্য ২। নৃত্যাঙ্গ ৩। জাতি শুন্য ৪। ভাবরঙ্গ ৫। ইষ্ট বাদ ৬। গতিভাব ৭। তরানা।
আরও দেখুনঃ
