আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ কথকলি নৃত্যশৈলী

কথকলি নৃত্যশৈলী
দক্ষিণ ভারতের প্রান্ত সীমা । আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী পর্বতশ্রেণী ও সমুদ্রের পটভূমিতে রচিত হয়েচে সুরম্য মালাবার উপকূলে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে য়ুরোপীয় জাতির ভারত আগমনের প্রথম অধ্যায় সূচীত হয়েছিল এখান থেকেই। যদিও সে সময় তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল শধ্যেই বাণিজ্য কিন্তু পরে, ভারতের রাজনৈতিক আবহাওয়া তাদের উদবোধ করেছিল এখানে সাম্রাজ্য স্থাপন করতে। ভারতে খৃষ্টধর্ম প্রচারের প্রথম বীজও রোপিত হয় এই মালাবারের মাটিতেই। সেই ঐতিহাসিক মালাবার উপকূলেরই তটভামের নাম হয় কেরালা, আর এই কেরলই হল কথাকলি নাতোর জন্মভূমি।
কেরল বা কেরালা প্রথমে ছিল জনার্থ দ্বাবীড় অধ্যূষিত অঞ্চল। দক্ষিণ প্রান্তের অন্যান্য ভাষাগুলি যেমন দ্বাবীড় ভাষা থেকে উদ্ভত, মালয়ালম ভাষার জন্মও হয়েছে তেমনি প্রার্থীড় ভাষা থেকে। কথকলী নৃত্যকাহিনী যে ভাষায় রচিত, তার নাম ‘আটকথা সাহিত্য’।
কথকলী মানে হল কথার মালা আর আটু মানে অভিনয় বা নত্যে । নৃত্যের জন্য যে কথা তারই নাম আটুকথা। সাহিত্যিকদের মতে, তির,বিতাংকুর অন্তর্গত কোট্টারঝরা রাজ বংশের রোহিণী নক্ষত্রজাত রাজা কর্তৃক এই ‘আট্টকথা’ সাহিত্য প্রথম জন্মলাভ করে । আটুকথাকে কেবলমাত্র দৃশ্যকাব্যই বলা চলে না, এটি শ্রাব্যকাব্যও বটে। দেখার সঙ্গে সঙ্গে যদি এর কথা বস্তু না শোনা হয়, তা হলে এর পরিপূর্ণ রসাস্বাদন সম্ভব নয়। উপরন্তু যাঁরা এর নাত্য- মাদ্রাদির সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা তো পরম আগ্রহে এই নৃত্যগীতাভিনয় দেখে পরিতৃপ্ত হন—রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিকে উপেক্ষা ক’রে।

কথকলি হ’ল কেরলের অন্যান্য প্রাচীন নত্যকলার পরিমার্জিত রূপে। প্রাচীন নৃত্যে বলতে বোঝায় চাকার-কুত্ত কুটিয়াট্টম, মোহিনীয়াট্টম, মীনাক্ষী নাটকম, কংস নাটকম প্রভৃতি। এইগলির অংশবিশেষ নিয়ে সৃষ্ট হয়েচে কথকলি ।
ইতিপর্বে’ সংস্কৃত ভাষায় নাট্যবস্তু রচিত হ’ত। রাজা কোট্টরকরাই প্রথমে আট্টভাষায় নৃত্যনাট্য রচনা করেন । এরূপে জানা যায় যে কালিকটের জারিন বংশীয় মানবদেবরাজ প্রবর্তিত ‘কৃষ্ণনাট্যম’ ( ১৬৫০ খৃ.) নৃত্যনাট্যের অননুসরণে রাজা কোট্টরকরা এদেশে ‘রামনাট্যম’ নৃত্যনাট্য রচনা করেন ।
রামনাট্যম প্রথম অভিনীত হয় ১৬৫৭ খৃষ্টাব্দে। রামনাট্যমের সংলাপ বা কথাবস্তু মণিপ্রবাল ভাষায় এবং গানগুলি মলয়ালম ভাষায় রচিত হওয়ায় নৃত্যনাটোর প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পেল । রাজা বুঝেছিলেন যে সমাজকে সম্পূর্ণ রূপে সুসংস্কৃত করে গড়ে তোলার পক্ষে কলাই হল প্রধান মাধ্যম এবং তা সকলের বোধগম্য হওয়া দরকার। অতঃপর রাজা সাহিত্য রচনায় মন দিলেন এবং কলাকে স্বসংস্কৃত করে তোলার ভার দিলেন কেরলীয় ব্রাহ্মণ কলাবিদ রূপ লিঙ্গোট নংপাতির ওপর।
কথকলি নৃত্যের বয়েস বোধকরি পাঁচশ’ বছরের বেশি নয়। ‘কথকলির উৎকর্য দেখা যায় উন্নায়িওয়ারিয়র-এর প্রসিদ্ধ আটকথা নলচরিতের মধ্যে ।…. নলচরিতের গানগুলি যেমন জনপ্রিয় তেমনি বহুল প্রচলিত । এর রচনাকাল অষ্টাদশ শতাব্দী। এই সময় কেরলীয়েরা এই কথার প্রতি যথেষ্ট আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। রাজ মহল ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে সে সময় এর পরে সমাদর।

সাধারণত কোন রাজার আদেশ কিংবা প্রেরণায় তখন সাহিত্য রচিত হত। আর সে সময়কার কবিরা প্রায়ই হয় রাজা না হয় কোন উচ্চবংশ সম্ভত হতেন । কথকলি অভিনেতদল পালিত হতেন বেশির ভাগই রাজপরিবারের অধীনে। নতুন নতুন আটকথা রচিত হত আর রীতিমত ভাবে অভ্যাস করার পর অভিনীত হ’ত। কোন কোন রসিক রাজা এই নাটকে অংশগ্রহণও করতেন মাঝে মাঝে। আটুকথার মূল্য তার সাহিত্যের গণে বিচাৰ্য ছিল না- অভিনয় যোগ্যতার মানদণ্ডে তার মান এবং মূল্য নিরূপিত হ’ত। সাহিত্য ছিল বহুকলি নৃত্যকলার অনামী।” (শ্রীমতী কে. গোমতি অমা লিখিত ‘কলকলি গ’। ‘সুরছন্দা’ শারদীয়া সংখ্যা, ১৯৫৬)।
কথকলি নৃত্যকে পাঠপোষকতা করে যে রাজন্যবর্গ’ এর উন্নতি সान করেছেন, তাঁদের কয়েকজনার নাম : রাজা কেরলবর্মী, রাজা গ্রাম পরেণ, কার্তিক থিরমেল প্রভৃতি ।
কথকলি নৃত্যাভিনয় যেমন ভাব সম্পদে, তেমনি নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। এর বিষয়বস্তু সাধারণত রামায়ণ, মহাভারত, পরাণ প্রভৃতি থেকে গ্রহণ করা হয়। এতদেশীয় প্রাচীন ধার্মিক ও সামাজিক অন; ঠানাদির প্রভাক ‘কথকলি’ নৃত্য বিশেষভাবে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় ।
কথকলি নৃত্যের বিষয়বস্তু থেকেই বোঝা যায় যে, এটি সমূহ নত ( Group Dance )। কথক নাতো যেমন ননৃত্যশিল্পীরা নাচের ফোল বা নত্যকাহিনী পাঠ করে শোনান, কথকলি সেরূপে মখের নয়। অঙ্গসঞ্চালন ও মন্দ্রো সময়ে তার অভিবারিতে সমদৃশ্য মূকাভিনয় হ’ল বহুকাল নংত্যের বৈশিষ্ট্য। চব্বিশ রকম সংযত ও অসংযত বা হক এতে প্রয়োগ করা হয়। শাস্ত্রোর নবরসের বাজনা এতে পরিস্ফুট করা হয়। আরেক বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে কোন মহিলা শিল্পী অংশ গ্রহণ করেন না। পুরুষের দ্বারা নারীর ভূমিকা অভিনীত হয় । প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আজকাল অবশ্য মেয়েরাও এতে অবতীর্ণ হচ্ছেন।

কথকলি নৃত্যের সাত্ত্বিক, আঙ্গিক কি আহার্য – অভিনয়ের এই চার ভাগই বর্তমান। রূপসজ্জার (মেক-আপ ) ব্যাপারে কথকলি শিল্পীরা চরিত্র ও স অননুযায়ী সমুখে সবুজে, সাদা, কালো, লাভৃতি মানে । বিটিম, সোলার বল তোড়া নামীয় বড় চেভিপরে, নামীয় ছোট আকারের বর্ণভষণ, কাঠের অলংকার, উত্তরীয়, ঘাগরা, মোতি বা পংতির কাজ করা ফিতে ি অন্যান্য বহু, প্রকার অলংকারাদি ও পোষাক ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া মাথোসের ব্যবহার এই নৃত্যের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। বহুকলির মত আর কোন ভারতীয় নাত্যেই ম,খোসের এবংপ ব্যবহার দেখা যায় না। বহুকলি নাতো মুখোসের ঘটা এবং রঙের ছটা বোধকরি দ্রাবিড় সভ্যতারই নিদর্শন ।
কথকলি নৃত্য-সঙ্গীতে দক্ষিণ ভারতীয় রাগ-রাগিণী প্রষক্ত হয়। এতে তাল-বাদ্যের ব্যবহার বেশি। যে তালগগুলি এতে ব্যবহৃত হয়, সেগুলির নাম—চা বাড়া, চাম্পা, আড়ান্দা, ত্রিপাড়া ও পাঞ্ছানী । এই হল কথকলি নৃত্যের সাধারণ তথা সংক্ষিপ্ত পরিচয় ।
আরও দেখুনঃ
