অভিনয় ও নৃত্য: ভাব, দেহ ও আত্মার ঐক্য

মানবসভ্যতার প্রাচীনতম শিল্পগুলোর একটি হলো অভিনয় ও নৃত্য। এই দুই শিল্পের শিকড় একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত— যেন দেহ ও প্রাণের মতো। অভিনয় ছাড়া নৃত্য অসম্পূর্ণ, আবার নৃত্য ছাড়া অভিনয়ের প্রাণ জাগে না। তাই প্রাচীন নাট্যশাস্ত্রেও বলা হয়েছে, “নৃত্যম্ নাট্যং চ সর্বং তু অভিন্নং”— অর্থাৎ, নৃত্য ও নাট্য অবিচ্ছেদ্য।

 

অভিনয় ও নৃত্য
অভিনয় ও নৃত্য

 

অভিনয় ও নৃত্য

অভিনয়ের মূল অর্থ ও উৎপত্তি

“অভিনয়” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষার “অভি” (দিকে, সম্মুখে) ও “নয়” (নেতৃত্ব দেওয়া বা পরিচালনা করা) শব্দ থেকে। অর্থাৎ, অভিনয় মানে— দর্শকের সম্মুখে চরিত্র বা ভাবের উপস্থাপন। ইংরেজি শব্দ acting এসেছে লাতিন actus থেকে, যার অর্থ “কর্ম” বা “কাজ সম্পাদন”। অর্থের দিক থেকে দুই শব্দেই কার্য, প্রকাশ ও উপস্থাপনের ভাব নিহিত।

অভিনয় আসলে একটি মননশীল প্রকাশভঙ্গি, যেখানে শিল্পী নিজেকে এক চরিত্রের রূপে রূপান্তরিত করে দর্শকের সামনে এক নতুন বাস্তবতার জন্ম দেন। যেমন কোনো অভিনেতা যখন শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করেন, তখন তিনি প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণ নন, কিন্তু তাঁর আচরণ, মুখভঙ্গি, কণ্ঠ, চোখের ভাষা ও দেহভঙ্গির মাধ্যমে এমনভাবে চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলেন যে দর্শক মুহূর্তের জন্য তাঁকেই শ্রীকৃষ্ণ বলে অনুভব করেন। এই কৃত্রিম অথচ প্রাণবন্ত অভিব্যক্তিই অভিনয়।

 

অভিনয় ও নৃত্য
অভিনয় ও নৃত্য

 

অভিনয় ও নৃত্যের পারস্পরিক সম্পর্ক

অভিনয় মূলত নাট্যকলার অংশ হলেও নৃত্যকলার মূলে অভিনয়ই নিহিত। নৃত্য কেবল দেহের নড়াচড়া নয়— এটি মনের অনুভূতি, আবেগ, ভাব ও কল্পনার ছন্দবদ্ধ প্রকাশ। তাই একজন নৃত্যশিল্পী কেবল তাল ও লয়ের মাধ্যমে নয়, বরং চোখ, মুখ, হাত ও দেহভঙ্গির অভিনয়ের মাধ্যমে তার অন্তর্লোকের ভাবকে দর্শকের মনে সঞ্চারিত করেন।

প্রাচীন ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রের প্রবক্তা মুনি ভরত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ নাট্যশাস্ত্র-এ অভিনয়কে চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করেছেন—
আঙ্গিক, বাচিক, আহার্য ও সাত্ত্বিক। এই চার প্রকার অভিনয় মিলে সম্পূর্ণ হয় “চতুর্বিধ অভিনয়”, যা নাট্য ও নৃত্য উভয়ের ভিত্তি।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অভিনয় ও নৃত্যের পারস্পরিক সম্পর্ক

অভিনয় মূলত নাট্যকলার অংশ হলেও নৃত্যকলার মূলে অভিনয়ই নিহিত। নৃত্য কেবল দেহের নড়াচড়া নয়— এটি মনের অনুভূতি, আবেগ, ভাব ও কল্পনার ছন্দবদ্ধ প্রকাশ। তাই একজন নৃত্যশিল্পী কেবল তাল ও লয়ের মাধ্যমে নয়, বরং চোখ, মুখ, হাত ও দেহভঙ্গির অভিনয়ের মাধ্যমে তার অন্তর্লোকের ভাবকে দর্শকের মনে সঞ্চারিত করেন।

প্রাচীন ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রের প্রবক্তা মুনি ভরত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ নাট্যশাস্ত্র-এ অভিনয়কে চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করেছেন—
আঙ্গিক, বাচিক, আহার্য ও সাত্ত্বিক। এই চার প্রকার অভিনয় মিলে সম্পূর্ণ হয় “চতুর্বিধ অভিনয়”, যা নাট্য ও নৃত্য উভয়ের ভিত্তি।

 

১. আঙ্গিক অভিনয়

“অঙ্গ” অর্থ দেহ। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, দৃষ্টি, মুখভঙ্গি, হাত ও পায়ের নড়াচড়া, শরীরের ভঙ্গি ও স্থিতি— এগুলোর মাধ্যমে যে প্রকাশ ঘটে, তাই আঙ্গিক অভিনয়। নৃত্যে আঙ্গিক অভিনয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নৃত্য হলো মূলত শরীরের ভাষা। ভরত মুনি অঙ্গ, উপাঙ্গ ও প্রত্যঙ্গ এই তিন ভাগে শরীরকে বিভক্ত করেছেন।

যেমন—

  • মুখের হাসি, চোখের দৃষ্টি, ভ্রুর নড়াচড়া — উপাঙ্গ

  • হাত-পা, মাথা, কাঁধ, কোমরের সঞ্চালন — অঙ্গ

  • আঙুল, পায়ের আঙুল, ঠোঁটের সূক্ষ্ম নড়াচড়া — প্রত্যঙ্গ

আঙ্গিক অভিনয় নৃত্যের প্রাণস্বরূপ, কারণ এতে রস ও ভাবের দৃশ্যমান রূপ প্রকাশ পায়।

২. বাচিক অভিনয়

বাচিক অভিনয় হল কণ্ঠের মাধ্যমে প্রকাশ। সংলাপ, আবৃত্তি, গান বা কণ্ঠস্বরের ওঠানামার দ্বারা চরিত্রের মনের অবস্থা ফুটিয়ে তোলা হয়।
নৃত্যে যখন গানের সঙ্গে ঠোঁট নড়ে, মুখে উচ্চারণ না করেও গানের ভাবকে চোখ ও মুখে প্রকাশ করা হয়— তখন তা বাচিক অভিনয়ের অন্তর্ভুক্ত।
কথক নৃত্য বা ভরतनাট্যমের মতো শাস্ত্রীয় ধারায়, বাচিক অভিনয় প্রায়ই কাব্যপাঠ, বোল বা তালের উচ্চারণের মাধ্যমে যুক্ত থাকে।

৩. আহার্য অভিনয়

“আহার্য” মানে বাহ্যিক অলংকার, সাজসজ্জা ও দৃশ্যপট। কোনো চরিত্রের মানানসই পোশাক, গয়না, মুখের মেকআপ, চুলের বিন্যাস, মঞ্চসজ্জা— এগুলোই আহার্য অভিনয়। এটি দর্শকের কাছে চরিত্রের বাস্তবতা বাড়িয়ে তোলে। যেমন— কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনেতার নীল পোশাক, মুকুট ও বাঁশি তাঁর চরিত্রকে দৃশ্যত জীবন্ত করে তোলে। নৃত্যেও আহার্য অভিনয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য; কারণ সাজসজ্জা, আলো ও রঙের মাধ্যমে পরিবেশের সৃষ্টিই দর্শকের রসাস্বাদনের একটি বড় উপাদান।

৪. সাত্ত্বিক অভিনয়

সাত্ত্বিক অভিনয় হলো মনের ভাবের নিঃশব্দ প্রকাশ। এটি অভিনয়ের সূক্ষ্মতম রূপ। শাস্ত্রকারেরা আট প্রকার সাত্ত্বিক ভাবের কথা বলেছেন—
স্তম্ভ (স্তব্ধতা), স্বেদ (ঘাম), রোমাঞ্চ, স্বরভঙ্গ, বেপথু (কম্পন), বৈর্ণ্য (বিবর্ণতা), অশ্রু (চোখের জল) ও প্রলয় (অচৈতন্য)।

এইসব অনুভূতি কোনো কৃত্রিম অভিনয়ে নয়, বরং অভিনেতার অন্তরস্থ অনুভূতির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। একজন প্রকৃত শিল্পী যখন চরিত্রে সম্পূর্ণভাবে আত্মমগ্ন হন, তখন এই সাত্ত্বিক ভাবগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায়।
নৃত্যে এই ভাবপ্রকাশই “ভাবাভিনয়” নামে পরিচিত— যা দর্শকের মনে রস জাগিয়ে তোলে।

অভিনয় ও নৃত্যের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক

নৃত্য ও অভিনয় তাই একে অপরের পরিপূরক। নৃত্যে লয়, তাল, ছন্দ যেমন দেহের নন্দনচেতনা প্রকাশ করে, তেমনি অভিনয় সেই দেহে প্রাণ ও ভাবের সঞ্চার ঘটায়।
নাট্যশাস্ত্রের দৃষ্টিতে নৃত্য কেবল শরীরচর্চা নয়; এটি “ভাব, রস ও আত্মার পরিশুদ্ধ প্রকাশ”— যেখানে অভিনয়ই নৃত্যের প্রাণ।

অতএব, বলা যায়—

“নৃত্যহীন অভিনয় দেহবিহীন প্রাণের সমান,
আর অভিনয়হীন নৃত্য প্রাণহীন দেহের মতো।”

Leave a Comment