আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নাচ।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নাচ

ডেগর্যানডপ্রে ১৮০০ সনে কঙ্গো নদীর তীরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নাচে প্রকান্ড লিঙ্গ স্প্রিং দিয়ে নাড়াচাড়া করা প্রত্যক্ষ করছেন। তারপর মিশর হেলেনীক প্রভাবিত হলে নারীগণ একই ধরনের উত্থিত লিঙ্গ ডায়নোসাস উৎসবে বহন করে, যদিও নিশ্চিতভাবে এই ব্যাপারে নাচ সমন্ধে কিছুই বলা যায় না ।
অন্যদিকে প্রাচীন মিশর (২০০০ খৃঃপূঃ) অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নাচের মূলশিল্প উপাদান অন্য চিন্তাচেতনায় সৃজন করেছে :পা ছুড়া ও দীর্ঘ পদক্ষেপে অতিক্রম করায় জীবন এক গুপ্তশক্তি ধারণ করে। জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ধিষ্ণুতা ঃ যেমন শিশু ও ফসল ক্রমাগত বেড়ে উঠে, যেমন সমবেত নাচ স্বাভাবিক পদক্ষেপ থেকে অতিমাত্রায় (দ্রুততরে) পৌঁছে এইভাবে এই অতিমাত্রা অবশ্যই মৃত্যুর মত জীবনধ্বংসী শক্তিকে ভাঙ্গবে।
২৫০০ খৃঃপূঃ মিশরের প্রাচীন ৬ষ্ঠ রাজবংশে কফিনের সঙ্গে গমনকারী নারী নাচুয়েগণ তাদের পা এত দূরে নিক্ষেপ করত যে তা সামনের লাইনের নাচুয়েদের মাথার উপরে প্রসারিত হত (প্লেট- ৯) এবং তাদের উত্তরসূরী মধ্যবর্তী সাম্রাজ্যে সামনা সামনি দুই সারিতে পরস্পরের দিকে লম্বা পা তুলে কাত (পেছনে) হয়ে নাচত । ক্যামেরুনে এই থিম (বিষয়বস্তু) অতিরঞ্জিত হতে হতে রণ-পা নাচে দাঁড়ায় ।
যদি পুনর্জীবনের ধারণা এই সকল দেহভঙ্গীমার উদাহরণে মূর্ত হয়ে উঠে, অন্য কৃষ্টিতে এটা নাচের ফরমে মূর্ত হয়ে উঠে। মলিউকাসের আলফিউরোগণ শোকাভূত বাড়ীর সামনে জোড়ায় জোড়ায় হাঁটে। তারা হাত ধরে সেতু রচনা করে তাতে একটা শিশু হেঁটে পার হয় যখন শিশুটা এক যুগলের হাত হেঁটে পার হয় এই যুগল সারির সামনে যেয়ে সেতুর বন্ধন বিস্তৃতিতে সহায়তা করে। এটা বাড়ীটা আটবার প্রদক্ষিণ না হওয়া পর্যন্ত চলেেত থাকে : জীবন, অনন্তকাল ধরে নিজেই পুনর্জীবিত হয়;যার শেষ নাই ।
কিন্তু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নাচ হয়ত একসঙ্গে (ডাইরেক্ট ফরমে নাচা যায়) বাস্তবসম্মত ভাবে প্রয়োগ করা যায় : টরেছ প্রণালীর প্রতিটি নাচুয়ে মুখোশ পরে এবং বৎসরে যত লোক মারা যায় সেই মৃত ব্যক্তিদের চেহারা এবং চালচলন অনুকরণ করে। এতে মনে হয় মৃতের প্রেতাত্মা ভর করার প্রথম লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়; মুখোশ নাচের অংশে পরবর্তী অধ্যায়ে এর মূল শিল্প উপাদান বিবৃত হয়েছে।
যখন একজন উরুবা নিগ্রো মারা যায়, “অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পূর্বে কাঠের মুখোশ তৈরী করা হয়, যে কেউ একজন এসে তা পরে সঙ্গে শবাচ্ছাদন বস্ত্র ও থাকে। এখন সে বিকৃত স্বরে উচ্চারণ করে সান্তনা এবং উপদেশ দেয় যেন মৃতাত্মা বলছে এবং সে নাচতে শুরু করে। মুখোশটি সংরক্ষণের জন্য নেয়া হয় তখন থেকে অরিশা অতিপ্রাকৃতিক শক্তিও কাছে থাকে।
মৃত ব্যক্তির আত্মা মুখোশ জীবনে ও ক্ষমতায় অংশ নেয় বলতে গেলে এটা বার বার ঐ মুখোশধারীর উপর ঝাঁপিয়ে পরে ও তাকে ভর করে”। ভলাগা ক্রেমসিস অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় মৃত ব্যক্তির পোষাক পরে নাচে এবং তার নামে বলে” তোমাদের সঙ্গে এটা আমার শেষ উৎসব। আমি খাওয়া-দাওয়া করব, পানাহার করব তারপর আমি আর কখনও আসব না”।
মিউজিকের ইতিহাসবিদদের জন্য পুরানর পাশাপাশি অধুনা রীতি প্রচলিত আছে ঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর কাছাকাছি পর্যন্ত জার্মানীতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মৃত ব্যক্তির আত্মারূপে সমবেত গায়কদলের ভাল গায়কেরা তার কবরে হেঁটে গিয়ে উপদেশ বাণী গাইত অনুষ্ঠানে ব্রাহমস-এর জার্মান রিকুইয়াম এর পঞ্চম দেহভঙ্গিমায় “এখন তোমরা বিমর্ষ” ছিল ভুল স্বীকার করে এই মত প্রত্যাহার করার শেষ প্রতিধ্বনি।
রোমান অর্চিমিমাস, আদিম মৃতের মুখোশ বহনকারীদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত, তাতে মৃত্যের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শোভাযাত্রায় অগ্রবর্তী হয়ে মৃতের মুখোশ, পোষাক-পরিচ্ছদ পরে তার চালচলন অনুকরণ করত। সেই একই প্রচলন চতুর্দশ শতাব্দীর ফরাসীদেশের রাজপুত্রদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরিলক্ষিত হয়। বিরাজমান পুরাতন ইউরোপীয় প্রথার মধ্যে আদিম বৈশিষ্য এখনও প্রসারিত।
সপ্তদশ শতাব্দীর হাঙ্গেরীয়ান অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত একজন মাটিতে পরে যায় যেন সে মরে গেছে, নারী পুরুষ তার চারদিক ঘিরে গান গেয়ে নাচে, তাকে এমনভাবে তৈরী করে যেন তারা একটা মৃতদেহ পেয়েছে, তারপর তারা তার সঙ্গে নাচে : কিছুদিন পূর্বে আমি হাঙ্গোরীয়ান এক শহরেও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার একটা অদ্ভূত নাচ প্রত্যক্ষ করি। একটা ঘরের মধ্যেখানে একজন লোক হাত পা সটান করে শুয়ে আছে।

তার মুখ এক টুকরা কাপড় দিয়ে ঢাকা। সে সেখানে একটুও নড়াচড়া না করে শুয়ে থাকে। যখন এটা শুরু হলো নারী পুরুষ তার চারদিকে ঘিরে হেঁটে হেঁটে গান গায় আর অর্ধেক কান্না করে, তার হাত বুকে ভাজ করে রাখা, পা বাঁধা, কখন তার পিঠে শুয়ে রাখে কখন পেটের উপর এবং তারসঙ্গে সবধরনের আচরণ করা হয়।
শেষমেস তারা তাকে ধীরে সুস্থে উপরে তুলে এবং তার সঙ্গে নাচানাচি করে, ধরতে গেলে এটা খুবই ভীতিপ্রদ কারণ এই লোক স্বেচ্ছায় নিজেকে শেষ পর্যন্ত নাড়াচাড়া করেনি, কিন্তু অন্যদের তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করতে দিয়েছে।
বলতে গেলে আমি হতবাক হয়ে দাঁড়ায়ে গেছি। কিন্তু আমাকে জানানো হলো একবার গড যাকে (এই ভূমিকায় যে থাকে) শাস্তি প্রদান করে এবং সে সত্যিকারের মারা গেলে যেমন মৃতগণের পক্ষে করে, কখন সে এই জীবনে আসে না” ।
বৃত্ত-নাচে শবের সঙ্গে মূলশিল্প উপাদান কি সম্ভবতঃ ঐ খেলা যাতে একদল গাদাগাদি করে বসে সামনে পিছনে ধাক্কা দেয় একজন লোককে যে মাঝখানে নিজেকে শক্ত করে ধরে দাঁড়ায়ে থাকে যেন শব যাতে সে বৃত্তের যে কোন অংশ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারে? শবকে ঘিরে নাচার অর্থ হাঙ্গেরীয়ান নাচের হিসাবে আলোচিত হয় না।
সব শেষে “মৃত ব্যক্তি (যাকে সাজান হয়) দাঁড়ায়ে পরে এবং সকলে আনন্দ নাচে অংশগ্রহণ করে-সমস্ত কার্যবিবরণীতে মনে হয় শেষ পুনরুত্থানের মোহনীয় আবেশ আছে। এই ফরমে (গঠনশৈলী) এটা বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়, হাঙ্গেরী এমনকি সাইলেশিয়া এবং ব্রান্ডেনবার্গে; ১৬৭৪ খৃষ্টাব্দে ক্লেইভে ইহুদীদের বিয়ের অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়।
জার্মানী এবং বহেমিয়াতে (সূপ্ত সৌন্দর্য সুন্দরী) শ্লিপিং বিউটির মুলশিল্প উপাদান সাহিত্যের পরিভাষায় সংযুক্ত হয়েছেঃ মৃত ব্যক্তি জীবনের চুম্বনে জাগে এবং বিবর্ণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান হয়ে উঠে জীবন্ত সামাজিক খেলাধুলা, এটা অথবা অন্য মূলশিল্প উপাদান ইটালিয়ান মৃতের নাচের ভিত্তি হয়ে আছে যা তাসকেনী থেকে সিসিলি পর্যন্ত জনগণের মধ্যে ছড়ায় আছে বিভিন্ন নামে যেমন মাটাচিনো, বারাবান অথবা লুসিয়া ইত্যাদি।
এই দলভুক্ত পুনরুত্থান মোহনীশক্তি সম্পন্ন, সারডিনিয়ানদের লোক-নাচের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ত্রিপদী ক্লারিনেটের তীব্র শব্দে (লাউনেড্ডা) লোকজন বৃত্ত গঠন করে অবনত মস্তকে দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে প্রতিটি দুঃখ ভারাক্রান্ত চেহারায় নাচে।
তাদের উত্তেজনা ক্রমাগত উচ্চ শিখরে উঠে যতক্ষণ না একজন ছেলে বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে তার পা মোড়ায়ে শক্ত করে ফেলে পাটিতে সটান পরে যায়। বৃত্ত নাচুেয়েগণ আরো উত্তেজিত হয়ে মাটিতে পদাঘাত করতে থাকে কপালে থাবড়াতে থাকে এবং হতাশায় হাঁটু গেড়ে বসে পরে।
তারপর লাউনেড়া সজীব আনন্দদায়ক স্বরে বাজতে শুরু করে, ছেলেটা লাফ দিয়ে উঠে পরে সুস্থ সতেজ এবং সকলে মিলে আনন্দ নাচে সমবেত হয়। এডোনিসের (ভেনাসের প্রিয় যুবক) মৃত্যু ও পুনরুত্থানের রূপান্তর সারডিনিয়ানদের লোক কাহিনীর এই নাচ, এটা যেন প্রকৃতির মৃত্যু ও জাগরণের প্রাচীন পুরাণের ঘটনা।
অসিরিস দেবীর মহাপ্রস্থান ও মহাআগমনকে প্রতিফলিত করে হয়ত মিশরীয় পুরোহিতগণ একদিন ওই সকল নাচ অনুষ্ঠিত করত, সমবেত নাচ এবং অনুকরণাত্মক নাচের মধ্যে দিয়ে এ্যাটিক (এথেন্স সমন্ধীয়) বিরহ গাঁথা বিন্যস্ত হবার পূর্বে প্রথম ব্যাক্যান্টিজগণ (গ্রীক সুরার দেবতার অনুসারী মহিলা পুরোহিত বা ভক্ত) হয়ত এইভাবে ডায়ানোসাসের পরিণতি নাচে পরিস্ফুটিত করত।
মূলশিল্প উপাদান নিজেই মৃত্যুর (মৃত্যু নাচ) দ্বারা মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধক এবং স্বতঃস্ফূর্ত নাচ, যা খুবই প্রাচীন । গ্রান চ্যাকোর টোবা জনগোষ্ঠীর মত আদিমতর শিকারী লোকের দ্বারা এটা অলরেডি সংগঠিত হয়েছেঃ যখন কোন মহামারী বিশেষ করে প্লেগ রোগ হুমকি হয়ে উঠে তখন তারা সবাই বৃত্তের আকারে সমবেত হয়।

একজনের পর একজন যেন মৃতবৎ ধরাশায়ী হয় এবং নিঃশ্বাসে প্রঃশ্বাসে ওঝা গান গেয়ে তাদেরকে অবশ্যই জীবনে ফিরিয়ে আনবে বিধায় অন্যেরা তাকে ঘিরে নাচতে থাকে । একজনের পর অন্যজন পুনরায় জ্ঞান ফিরে পায় ও আর একবার নাচে অংশ নেয় যতক্ষণ না সবাই শুরু করার অবস্থায় ফিরে আসে।
কল্পনাহীন যুদ্ধনাচে যোদ্ধার মধ্যে জয়ের মোহিনীশক্তি অনুপ্রবিষ্ঠ হয়, মুখাভিনয়-কৃষ্টি সাদৃশ্যময় সুপ্তশক্তির বিরুদ্ধা করে। নাচের মাধ্যমে জয়সূচক যুদ্ধ চিত্রায়নের লক্ষ্য হচ্ছে অভিযাত্রার শুভফল প্রাপ্তি। কল্পনাহীন নাচে অস্ত্রের প্রয়ো কিন্তু কল্পনাপ্রবণ নাচে অস্ত্র অপরিহার্য।
আরও দেখুনঃ
